বশিরুল
ইসলাম : কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার জয়াগ গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধা আফজলের
নেছাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন তার ছেলে ও
ছেলেবউ। হাসপাতালের ডাক্তার জরুরিভিত্তিতে রোগীর সিটি স্ক্যান করার কথা
বলেন। কুমেক হাসপাতালে সিটি স্ক্যান থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে বাইরে গিয়ে সিটি
স্ক্যান করাতে হয়। সেখানে দুই থেকে তিন গুণ বেশি টাকা গুনতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত কুমেক হাসপাতালে দীর্ঘ দিন থেকে সক্রিয় একটি
দালাল চক্রের কারসাজিতেই তাদেরকে বাইরের ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে বেশি
টাকায় সিটি স্ক্যান করাতে বাধ্য হতে হয়। আফজলের নেছার ছেলে জানান, তিনি
হাসপাতালের সিটি স্ক্যান বিভাগে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে সিরিয়াল আছে,
অনেক দেরি হবেÑ এসব শোনানো হলে তিনি মাকে দ্রুত বাইরে নিয়ে গিয়ে সিটি
স্ক্যান করিয়ে আনেন।
এভাবে দালাল চক্রের দৌরাত্মে কুমিল্লা মেডিক্যাল
কলেজ হাসপাতালের রোগী ও রোগীর স্বজনরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। মূল ফটক থেকে
ওয়ার্ড পর্যন্তÑ গোটা হাসপাতালে দালালদের অবাধ চলাফেরা। ভুক্তভোগীদের
অভিযোগ, বেসরকারি হাসপাতাল, কিনিক ও ডায়গোনস্টিক সেন্টারের নিয়োগ করা
দালালদের হাতে জিম্মি কুমেক হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা। মাঝেমধ্যে
ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশের অভিযানে দালালদের আনাগোনা কমে এলেও কিছুদিন পর
আবার আগের অবস্থা ফিরে আসে।
আফজলের নেছার ঘটনাটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে
কুমেক হাসপাতালের রেডিওগ্রাফি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের টেকনোলজিস্ট আল
মামুন বলেন, ‘এই হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করার জন্য কোনো সিরিয়াল দিতে হয়
না। কে বা কারা তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে বাইরে নিয়ে গেছে, তা বলতে পারছি না।’
গত
১৪ মার্চ, রবিবার কুমেক হাসপাতাল ঘুরে রোগী, রোগীর স্বজন ও স্থানীয়দের
বক্তব্য শুনে এবং সরেজমিনে দেখা যায়, কুমেক হাসপাতালের যেখানে রোগী আছে,
সেখানেই দালাল আছে। দালালদের বেশিরভাগই অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার অথবা
হেলপার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ রকম এক হেলপার বলেন, ‘আমরা মাগনা রোগী
ভাগাই না। ভিতরে টাকা দিয়া রোগী ভাগাই। তাই রোগীর থেকে আগেই টাকাটা নিতে
হয়। এখানে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। আজকে আজকে কারো নাম বললে কালকেই তো আমার
নাম দিয়াই নিউজ করবেন। ভেতরে প্রতিশ্রুতি দিতে হইছে, কারো নাম বলা যাবে
না।’
আরো জানা যায়, হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ও হেলপারদের
মোবাইল ফোন নাম্বার থাকে হাসপাতালের গুটিকয়েক ডাক্তার, নার্স ও বেশিরভাগ
আয়াদের কাছে। তারা রোগীর খবর দিলে ওই ড্রাইভার-হেলপার তথা দালালরা তাদেরকে
কমিশন দিয়ে বিভিন্ন কায়দায় রোগী ভাগিয়ে নেয় হাসপাতালের বাইরে। কিছু আছে
বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল। ‘কুমেক হাসপাতালে পরীক্ষা করতে
সিরিয়াল দিতে হবে, রিপোর্ট পেতে দেরি হবে’Ñ রোগীদের এ ধরনের নানা ভুল তথ্য
দিয়ে বিভ্রান্ত করে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যায় তারা। অভিযোগ আছে, প্রতিদিন
আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা
হাসপাতালের ভেতওে ঢুকছে অবাধে। বিনিময়ে প্রতি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে
তারা পায় নির্দিষ্ট হারে টাকা।
বুড়িচংয়ের আকলিমা, লাকসামের রাবেয়া,
দেবিদ্বারের লোকমান ও সাব্বির প্রায় একই ভাষায় জানান, তাদের নিকটাত্মীয়রা
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এই
হাসপাতালে প্রতিটি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও দালালরা তাদেরকে বাইরে গিয়ে
পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রভাবিত করে। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন
অভিযোগ মেলে ভুরি ভুরি।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনেরা
প্রতিনিয়তই দালালের খপ্পরে পড়েন। সরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষা নেই, অল্প
খরচে বাইরে থেকে পরীক্ষা করিয়ে দেবো; এখানে প্রচুর ভিড়, বাইরে সাথে সাথে
রিপোর্ট দেওয়া হবে, এখানে মেশিন নষ্টÑ এ রকম নানা কথা বলে রোগীর স্বজনদের
বিভ্রান্ত কওে দালালরা। উদ্বিগ্ন স্বজনরা অনেকেই দালালের কথায় প্রভাবিত হয়ে
সরকারি হাসপাতাল ত্যাগ করে ওদের সঙ্গে বাইরে ছুটে যান।
বিষয়গুলো
উত্থাপন করলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিনও বলেন, ‘এই হাসপাতালে
দালাল ও চোর চক্রের দৌরাত্মের কারণে আমরাও অতিষ্ট। এ বিষয়ে হাসপাতালের পক্ষ
থেকে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। হাসপাতালের গেটের সামনেই
সারিসারি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকে। এগুলোকেও সরানো যাচ্ছে না। আশা করি,
সবার সহযোগিতা পেলে হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত হবে।’