ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
মুক্তিযুদ্ধের ক’জন শহীদ স্মরণে স্বগোক্তিÑখোদোক্তি
Published : Friday, 26 March, 2021 at 12:00 AM
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী ।।

ভূমিকাঃ
আজ ২৬ শে মার্চ ২০২১ সাল। আমাদের সুমহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। এদিনে কুমিল্লা জিলা স্কুলের সাবেক ও বর্তমান ছাত্রগণ মিলে তাদের সহযাত্রী বা পূর্বসূরী ১২৮ জন মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ‘মুক্তিযোদ্ধা চত্বর’ নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করবে। এই ১২৮ জনের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ৬ জন; তবে সর্বমোট শহীদদের সংখ্যা ১১ জন। আজকে শ্রদ্ধাভরে তাদের কয়েকজনকে স্মরণ করছি।
মূল প্রসঙ্গঃ
শরতের পড়ন্ত রোদে আমাদের ক্যাম্পটাকে মনে হচ্ছিল নীরব, নিস্তেজ, নিথর, অনেকটা নিঃসঙ্গ। একটা তাঁবুতে আমি একা। কিছু আগে আগরতলা থেকে ফিরে এসেছি। আজ সেখানে একটা সভা ছিল। মনি ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কঠোর ভাষায় বাংলাদেশ সরকারের একটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছি। মনি ভাইয়ের বক্তব্য ছিল দেশ আমাদের; তাকে শত্রুমুক্ত করতে যত রক্তের প্রয়োজন তা আমরা দেব। যৌথ কমান্ডের ব্যাপারে আমাদের অসম্মতি ছিল। আমাদের থলেতে যুক্তি ছাড়াও আবেগ ছিল প্রচুর। সেগুলো গ্রহণযোগ্য হলেও দু’দিন আগে বেতারে সংকেত পেয়েছি ‘তোমাদের লাশ শকুন খাবে’;  স্বপরে এমনি উক্তি বুকে কম্পন ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। বিষন্নতা নিয়ে নিঃসঙ্গ তাঁবুতে বসে থাকতে থাকতে একটা ছায়া অবলোকন করলাম। দেখলাম কুঁচকুঁচে কালো একটা চেহারা-যাকে স্কুলে তার বাবার সহকর্মী শিকরা নিগ্রোর বাচ্চা বলত। তার চুল আমাদের চেয়েও কালো ছিল ঠিকই; কোঁকড়ানো ছিল না। ঝাঁকড়া ছিল তবে চিরুনীও চালাতে অসুবিধা হতো না। সেদিন মুখে তার দাঁড়ি ছিল, তবে কালো মানুষের কালো দাঁড়ি ছিল মানানসই অস্পষ্ট। অতীতে দেখেছি ঝকঝকে দাঁত কটি ঠোঁট ঠেলে বের হলে তার মুখের বিষন্নতা মিলিয়ে যেতো। যিনি এলেন এবং যার কথা বলছি তার নাম মোজাম্মেল হক ডাক নাম আবু; বি কম পাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম কম ১ম পর্বে ভর্তির সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন। যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে যুদ্ধে চলে এসেছেন। তার আসল নাম আর আমার আসল নাম অর্থ্যাৎ বাবার দেয়া নামটা একই ছিল। আমার আসল নাম জানা থাকলে তার নাম মোজাম্মেল হতো না। সে আমার ভাস্তে-চাচাত ভাইয়ের ছেলে, বলতে গেলে আমরা পিঠা পিঠি। এক সাথে বড় হয়েছি। একই স্কুলে পড়েছি। ছোটবেলায় ৫ জনে এক রিকশায় চড়ে স্কুলে গিয়েছি, খেলাধুলা করেছি, রাতে হাডুডু খেলতে কিংবা যাত্রা দেখতে এক সাথে গিয়েছি। আর কত কি! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রাক্কালে তার আসল নাম জেনেছি কিন্তু তার মনে যে এত আগুন তা জেনেছি আরও পরে। আবু আমাদের মত ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। ষাটের দশকে আমরা ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা; তুমি কে আমি কে বাঙ্গালী বাঙ্গালী; জিন্না মিয়ার পাকিস্তান-আজিমপুরের গোরস্থান জাতীয় স্লোগান এবং সত্তরের নির্বাচনে ‘নৌকা মার্কায় ভোট দিন, স্বাধীনতা শপথ নিন’ বা আরও পরে ‘কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, জাতীয় স্লোগানে রাজপথ কিংবা জনপথ মুখরিত রেখেছিলাম। আবু যে কাছে দাঁড়িয়ে এসব আত্মস্থ করছিল বা ঐ সবে নিজকে একান্ত সঁপে দিচ্ছিল তা তখন চোখ মেলে দেখার তেমন সুযোগ পাইনি। ২৫ রাতে বা এপ্রিলের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এক সাথে থেকে একটু বেশি রকম বুঝতে শুরু করেছিলাম। তার হৃদয়ে যে বারুদ আছে এবং বারুদের মত সময়মত জ্বলে উঠার বাসনা আছে তা জেনেছি তখনই যখন সে স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে গেরিলা যুদ্ধে ট্রেনিং এ গেল। ট্রেনিং শেষে ইনডাকশনের জন্য তার ব্যাকুলতা থেকে তার দেশাতœবোধ, মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম দরদ, পাকিস্তানী হানাদারদের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা ও দেশকে শত্রুমুক্ত করার দৃঢ়তা ল করেছি। ইন্ডাকশনের সময় নির্দেশ ছিল নিজকে মাত্রারিক্ত আড়াল করে রাখা, জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া, নতুন যোদ্ধা তৈরী করা, হিট ও রান-এর মাধ্যমে শত্রুকে নাস্তানাবুদ করা এবং পরবর্তী মোম সময়ের নির্দেশ ব্যতিরেকে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হওয়া। দেশকে দ্রুত স্বাধীন করার ব্যাকুলতায় বা সহযোদ্ধাদের শত্রুর সাড়াশী আক্রমণ থেকে রার জন্যে আগষ্টের শেষ দিকে আবু সহ পাখীর পুরো টীম মনি ভাইয়ের শেষ নির্দেশ অমান্য করেছিল। অধিনায়ক মনি ভাইয়ের তলব পেয়েই আজ সে এসেছে। তবে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখির জন্য নয়, আরও অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিতে। আমি তাকে দেখলাম খুব হৃষ্টচিত্তে নয়, কারণ চীফ ইতিমধ্যে আবুদের নির্দেশ অমান্যের জন্যে আমাকে বকেছেন। চীফ আমার সাথে আবুর সম্পর্কের কথাও জানতেন। আমি আবুকে অধিনায়ক মনি ভাই-এর মনোভঙ্গীর কথা বললাম এবং তার যে কোর্টমার্শাল হতে পারে তাও জানালাম। যুদ্ধ আমাদেরকে কত নির্মম ও নির্দয় করে তুলেছে তা অনুভব করলাম, তবে সান্ত¡না ছিল যে যুদ্ধটা ভাড়াটে সৈন্যের যুদ্ধ ছিল না, পররাজ্য গ্রাসের যুদ্ধ ছিল না, তা ছিল দস্যু, তস্কর, দুর্বত্তের হাত থেকে মা ও মাতৃভূমিকে উদ্ধারের লড়াই; ধর্মব্যবসায়ী ও ফতোয়াবাজদের কবল থেকে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে স্বকীয়তায় সংস্থাপনের লড়াই, অন্নের লড়াই, বস্ত্রের লড়াই, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাবার লড়াই।
মনি ভাইয়ের কথাগুলো আবু শুনেছে, বলল, ‘জানি আপনার উপস্থিতিতে কোর্ট মার্শাল জাতীয় কিছু হবে না; তাছাড়া মনি ভাই আমাদের যুক্তির কাছে হার মানবেন।’ মনি ভাই এলেন এবং কি পরিস্থিতিতে তারা সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল তা ব্যাখ্যা করলাম। আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ পাকিস্তান হানাদার আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তাদেরকে বিপন্ন দেখে নিষেধ সত্ত্বেও পাখীদের দলটি সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রাণহানি না ঘটলেও প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ হারান গিয়েছিল। ব্যাখ্যা গৃহীত হলেও মনি ভাই আবারও চে গুয়েভারার কথা স্বরণ করিয়ে বললেন, ‘একজন প্রকৃত গেরিলা কখনও মরে না’।
একটু পরে আবু গোলা বারুদের একটা দীর্ঘ তালিকা পেশ করলো। বয়ে নেবার কষ্ট বিবেচনা করে নতুন যাদের ইনডাকশন হবে তাদের সাথে সেও ফিরে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। আমার সাথে অন্তত দুটো দিন কাটাবার ইচ্ছে থাকলেও চীফের আদেশ অমান্য করে তার থাকার জো ছিল না।
আজকের বিকালটার সবাই অন্যত্র ব্যস্ত। যে ব্যক্তিদের ট্রেনিং শেষে হয়েছে তাদেরকে আজ অস্ত্র দেয়া হয়েছে, নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানা দেয়া হয়েছে। কুরিয়াররা এসে গেছেন। উদ্ধুদ্ধকরণসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেয়া হয়ে গেছে। রাতে তারা চলে যাবে। নাজমুল হাসান পাখীর নেতৃত্বে সে রাতে আবু, সাফু, মেহরাব, বাশার, নীপেন, বাকী, নূরু, শরিফুল মোমিন ও আর এক আবুসহ সবাই চলে গেল। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে তাদের দলটি অতর্কিতে পাকিস্তান সেনা আক্রমণের সম্মুখীন হলো। মৃত্যুকালে আবু কি বলেছিল জানি না।
তবে আমি তার মাঝে ১১ সেপ্টেম্বর এক অন্য আবুকে দেখেছিলাম। মনে হয় এই পৃথিবী বা এই গ্রহের কেউ নয়, মজিদ ভাই বা মাহমুদা ভাবীর সন্তান নয়, বকুল, বাবুল, পান্না, বুলবুল, পারভীন বা টুটুলের ভাই নয়, কোন এক দূর গ্রহের বিষন্ন নাবিক। খবর এলো আমার আবু আর নেই। শুধু এই আবু নয় কেনু ভাইয়ের ভাই আবু, আমাদের দু’প্রজন্মের আত্মীয় সাইফুল মানে সাফুও শহীদ হয়েছে। সাফু একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিল, কেনু ভাইয়ের ছোট ভাই আবু কুমিল্লা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণীর ফাস্ট বয়, গরীবের সন্তান। আমিও জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ছোট বলে আমরা তাকে ট্রেনিং-এ পাঠাতে চাইনি। অনেকটা আমাদের অজান্তে বয়স ও কাস লুকিয়ে ট্রেনিং-এ চলে গেল। ট্রেনিং এ অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে আমরা মানে চীফসহ তার ইনডাকশনের ব্যাপারে তেমন আপত্তি করিনি।
এখন গ্লাস ফ্যাক্টরীর আমাদের বেস ক্যাম্পে শোকের ছায়া। কারো মুখে কথা নেই। পাতা পড়ার শব্দটিও শুনা যাচ্ছে। আমার শক্তি ফুরিয়ে গেছে। একটি অস্পষ্ট কান্না কন্ঠ ভেদ করতে গিয়ে থেমে গেল। ভয়, অন্যদের নৈতিক বল বা মনোবল ভেঙ্গে যায়। একজনের কাঁধে ভর দিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে কোনভাবে কলেজ টিলায় পৌঁছলাম। অসময়ে আমাকে দেখে কেনু ভাইয়ের কলিজায় মোড় দিল। মুখের ভাব দেখে বুঝলেন কিছু একটা ঘটেছে। ঘরে ঢুকলাম, মাথায় দুটো হাত রেখে বসলাম। দেহের ভার সইতে না পেরে দেহটাকে মেঝেতে এলিয়ে দিলাম। কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় গাইতে শুরু করলাম ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা কে বলে আজ তুমি নেই?’ এবারের চোখে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার। কেনু ভাই জিজ্ঞেস করলেন ‘স্যার কি হয়েছে?’ যুদ্ধকালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার ছিলাম। তাই কেউ কেউ আমাকে স্যার বলতেন। তবে মনি ভাইয়ের নির্দেশক্রমে আমরা আমাদের পরিচিতি বরাবর গোপনই রেখেছি। কেনু ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে বললাম “আবু মারা গেছে”। মুহূর্তে মাথায় দু’হাত জড়িয়ে কেনু ভাই মাটিতে বসে পড়লেন, পৃথিবীটা তার চোখের সামনে দোল খাচ্ছিল, অঝর কান্নার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন ‘স্যার, কোন আবু?’ আমি বললাম ‘মজিদ স্যারের ছেলে আবু।’ তখনও বলতে পারছিনে যে তার ভাই আবুও আর নেই।’ বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছি ‘হয়তো আসিব ফিরে এই বাংলায়, মানুষ কিংবা শঙ্খচিল বেশে।’ কান্নায় কান্নায় অনেক সময় চলে গেল। আমি কেনু ভাইকে শক্তভাবে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কান্নার বেগ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় পোড়খাওয়া মানুষ কেনু ভাই বুঝে নিলেন। বললেন, ‘স্যার, লুকোচ্ছেন কেন, আমার ভাইটিও নেই?’ কি জবাব দেব। চোখের জল কথা বলে দিল।
পরের কথা বলছি। বড্ড ভেঙ্গে পড়েছি। আগের মত প্রাণ চাঞ্চল্য নেই। প্রতিদিন মৃত্যুর খবর আসছে। আহত হচ্ছে অনেকেই। হানাদার পাকিস্তানী, কুলাঙ্গার জামাত ছাত্রসংঘসহ অন্যান্য পাকিস্তান পন্থীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে। নিজের জীবনটাকে আগের মত এত মূল্যবান মনে হচ্ছে না। সে যা বলুক আমি আবুদের সাথে মিলে যাবার কথা ভাবছি। মনি ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম, আমাকে আতœঘাতি দলে অন্তর্ভুক্ত করতে। কিন্তুু না, মনি ভাই অবিচল, দৃঢ় ও শীতল। দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি, রাগারাগির এক পর্যায়ে মনি ভাই আমাকে কোর্ট মার্শাল করবেন, বলে ধমক দিলেন। আমি বললাম, ‘আপনি আবুকেও কোর্ট মার্শাল করতে চেয়েছিলেন।’ হঠাৎ মনি ভাই স্বর খুব নীচে নামিয়ে আনলেন, বা হাতে সিগারেট ধরে ডান হাত দিয়ে আমার কাঁধ আকড়ে ধরে ছোট ছোট পদে হাঁটতে লাগলেন। তিনি বললেন, ‘দেখ মান্নান, দেশ সহসা স্বাধীন হবে। এই যুদ্ধে তোমার যা করণীয় তা করেছো। পরের যুদ্ধে তোমাদের প্রয়োজন হবে ঢের বেশি। আমি তোমাকে হারাতে পারি না। তাছাড়া তোমার পরিবার সম্পর্কে আমার সব জানা, আমি তোমার বিধবা মায়ের বুক ভেঙ্গে দিতে পারব না। আমরা চাটগাঁয়ে যাচ্ছি। শিগগিরই একটা স্থায়ী ভুখন্ড দখল করে সেখানে প্রবাসী সরকারকে নিয়ে বসাব। বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায় করব। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে। তুমি সেক্টরের দায়িত্বে থাকবে আর যৌথ বাহিনী তৈরী হলে তুমি মুজিব বাহিনীর হয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে।’
শেখ ফজলুল হক মনি, মানে মনি ভাইয়ের কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমি রয়ে গেলাম। তবে মনি ভাইয়ের ইচ্ছানুযায়ী দেশ গড়ার সুযোগ কোনদিন পাইনি। যুদ্ধ শেষে অপবাদ পেয়েছি প্রচুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলে যাওয়া চাকুরিটা পুনরুদ্ধার করতে বঙ্গবন্ধুর হস্তপে প্রয়োজন হয়েছিল। তারপরে নিঃশব্দে একা পথ চলা, বৃত্তি পেলাম। দেশ ছাড়লাম। দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ল না। ৩১ জুলাই ১৯৭৫ সালে দেশে ফিরে এলাম। মনি ভাই এবারে কিছু দায়িত্ব দিলেন। পনের দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। নিহত হলেন মনিভাইসহ আরও অনেকে। ড্রাগনের নিঃশ্বাস আমাদের গায়েও লাগলো। আবারও দেশ ছাড়লাম। এবারে চাকুরির উছিলা দেখিয়ে। আরাম কেদারা, আরাম বিছানা, গাড়িতে, বাড়িতে, অফিসে এয়ারকন্ডিশন, মাসে বড় অংকের মাসোহারা, সম্মান, সমীহ ‘বিগ বসের কত আদর, কত কদর। না, শান্তি স্বস্তি আর রাতের ঘুম আমাকে ছেড়ে গেছে। রোজ রাতে কিসব স্বপ্ন দেখি, থরথর করে কাঁপতে থাকি। ঘামে গা ভিজে যায়। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। বাকি রাত বিনিন্দ্র কাটিয়ে দেই। প্রতিরাতে ওরা আসে। মোজাম্মেল, আবু, সাফু, আবু তাহের, মতিন মাষ্টার, নজরুল, কিবরিয়া স্বপনরা আসে। এসে কেউ বলে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলাম, কেউ বলে ছু’টিতে গিয়েছিলাম, কেউ বলে তোমাদের কাছ থেকে ণিকের জন্যে পালিয়েছিলাম; কেউ বলে অপারেশনে গিয়েছিলাম। রক্তাক্ত ঝাঁঝড়া বুক, মস্তক বিহীন ধড়, কাটা হাত বা কাটা পা নিয়ে সামনে দাঁড়ানো মাত্রই অস্থির হয়ে যাই। দেশে থাকাকালীন অবস্থায় এমনটা হতো। তবে সময়টা ছিল পঁচাত্তরের আগষ্টের পর। তিষ্ঠিতে না পেরে পালিয়েছিলাম। যে সময় ভাবতাম পালিয়ে গেলে তারা আর পিছু তাড়া করবে না। এখন দেখছি তারা ক্রামাগত আমার দিকেই ফিরে আসছে। চাকরি ছেড়ে দিলাম। দেশে ফিরে স্বপদে সহসা যোগদান করতে পারলাম না। স্বজনরা বা সহযোদ্ধারা সংকট বাঁধিয়ে দিয়েছে। আবারও ঘুম নেই। আবারও তারা আসছে। হঠাৎ আন্দোলনের ডাক। নিজকে জড়িয়ে নেই, নাম ফুটাবার জন্যে নয়, জনপ্রিয়তা দিয়ে সংসদ বা মন্ত্রিত্বের জন্যে নয়, শুধু একটু শান্তির ঘুম ধুমাতে। আমি লীর বরপুত্র হতে চাইনি। অমরাবতীর পুত্র হবার অভিলাষ আজও আমার আছে। এখন বিকালের নরম রোদে দেহের লোমগুলোতে উষ্ণতা দিয়ে শীতার্ত আবুদের অবসন্নতা ঘুচাতে পারব কি?

*অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপদেষ্টা।