স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু
Published : Friday, 26 March, 2021 at 12:00 AM
ড. এ কে এম এমদাদুল হক ।।
আজ
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস।এই দিনে বিশে^র মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র
হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।সবুজ জমিনে রক্তিম সূর্যখচিত মানচিত্রের এ
দেশটির স্বাধীনতার ৫০ তম বার্ষিকীও আজ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এ দিনটি
বাংলাদেশের ¯্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের
জন্মশতবার্ষিকীর বছরও। এর সাথে যোগ হয়েছে একটি নতুন পালক স্বল্পোন্নত দেশ
থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরনে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ।
এ যে অর্জন তার
নেপথ্যে অনেক ইতিহাস। অনেক ত্যাগ। অনেক শ্রম। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম। আমরা
জানি, দ্বি’জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে এ উপমহাদেশ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল ১৪ আগস্ট
১৯৪৭। সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান নামক এক অদ্ভুত আকৃতির রাষ্ট্রের যেখানে
পূর্ব অংশের সাথে পশ্চিম অংশের ব্যবধান ছিল বিশাল। আবার শাসন প্রক্রিয়াও
ছিল সেই ব্রিটিশ আমলের মত। এবার পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের
শাসন ও শোষণ। পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের ন্যূনতম যা দরকার পশ্চিম পাকিস্তানী
শাসক গোষ্ঠী তাও দেয়নি। ১৯৫৫-১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের গৃহিত
তিনটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ফলে পূর্ব বাংলার উপর শোষণ ও বঞ্চনার চিত্র
দৃশ্যমান হয়। প্রথম পরিকল্পনাকালে সমগ্র বিনিয়োগের মাত্র ২৬ শতাংশ পূর্ব
বাংলায় ব্যয় করা হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিকল্পনাকালে তা হয় যথাক্রমে ৩২ ও ৩৬
শতাংশ। ৩য় পরিকল্পনাকালে উন্নয়ন ও সাধারণ ব্যয় খাতে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম
পাকিস্তানের মধ্যে মাথাপিছু ব্যয় হয় যথাক্রমে ২৪০ টাকা ও ৭০ টাকা এবং ৫২১
টাকা ও ৩৯০ টাকা।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক অর্জিত বৈদেশিক
মুদ্রা দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়। আর উৎপাদিত
শিল্পজাত পণ্য চড়া দামে পূর্ব বাংলায় বিক্রি করে পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম
পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করা হয়। যেমন ১৯৫১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে
কৃষিকাজ করতো ৬৫.৩০ % লোক অথচ ১৯৬১ তে এ সংখ্যা কমে হয় ৬০.৩০%। ১৯৫১ সালে
পূর্ব বাংলায় কৃষি কাজ করতো ৮৪.৭০ % লোক অথচ ১৯৬১ তে এ সংখ্যা বেড়ে হয়
প্রায় ৯০%। অথচ আমরা জানি পাকিস্তান শিল্পভিত্তিক কোন রাষ্ট্র ছিল না। এটি
ছিল একটি কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্র। কৃষিজাত পণ্য রপ্তানী করে পাকিস্তানকে টিকে
থাকতে হতো। পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানীকারক পণ্য ছিল পাট। এ পাটের ৬৫ %
উৎপন্ন হতো পূর্ব বাংলায় অথচ কেন্দ্রিয় সরকার যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো
তার মাত্র ৩০% ব্যয় করতো পূর্ব বাংলার জন্য বাকী ৭০% ব্যয় করতো পশ্চিম
পাকিস্তানের জন্য। তাছাড়া পূর্ব বাংলার জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হতো তা দিয়ে
কিছু বিল্ডিং, রাস্তা, দর্শনীয় বস্তু প্রভৃতি চাকচিক্যপূর্ণ লোক দেখানো
একপেশী উন্নয়নমূলক কর্মকা- পরিচালনা করা হতো। ১৯৬৮-১৯৬৯ পর্যায়ে পশ্চিম
পাকিস্তানের আয়ের পরিমাণ পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ফলে
পূর্ব বাংলার মানুষের জীবন যাত্রার মান কমে যায় মারাত্বকভাবে।
১৯৫৪ সাল
পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিশাল
বৈষম্য দেখা দেয়। ১৯৫৪ সালের ৪ মার্চ যুক্তফ্রন্ট অফিস থেকে “জালেম শাহীর ৬
বছর” শিরোনামে প্রকাশিত এক পুস্তিকায় শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যের চিত্র তুলে
ধরা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় ৪টি অথচ পূর্ব
পাকিস্তানে ২টি। পশ্চিম পাকিস্তানে মেডিকেল কলেজ যেখানে ৫টি সেখানে পূর্ব
পাকিস্তানে মাত্র ১টি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের চিত্রও অনুরুপ। পশ্চিম
পাকিস্তানে ৮টি টেক্সটাইল কলেজ ও ২টি ফরেস্টারি কলেজ থাকলেও পূর্ব
পাকিস্তানে ১টিও ছিল না। সাধারণ কলেজ পশ্চিম পাকিস্তানে ৭৬টি ও নতুন
প্রাথমিক স্কুল ৫২৪৬ টি থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে ছিল যথাক্রমে ৫৬ ও ২২১৭টি।
১৯৪৭ উত্তর পর্যায়ে প্রশাসনে বাঙালিদের কোন স্থান ছিল না। তখন যারা
প্রশাসনে ছিল এরা হয় সামরিক বাহিনীর লোক নয়ত তাদের সাথে সামঞ্জস্য
রক্ষাকারী দল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯ জন সচিব
থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের কোন সচিব ছিল না। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে যুগ্ম
সচিব, উপ সচিব ও সহকারি সচিব ছিল যথাক্রমে ৩৫, ১২৩ ও ৫১০ জন। অপরপক্ষে
পূর্ব পাকিস্তানে ছিল যথাক্রমে ৩, ১০ ও ৩৮ জন।
প্রতিরক্ষা বাহিনীতেও
বৈষম্যের চিত্র ব্যাপক। তখন ১৭ জন জেনারেলের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিল বাঙালি।
সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মরত ছিল
যথাক্রমে ৮৯৪, ৫৯৩ ও ৬৪০ জন। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত ছিল
যথাক্রমে মাত্র ১৪, ৭ ও ৬০ জন।
একটি রাষ্ট্রের দু’অঞ্চলে দু’ধরনের
সংস্কৃতি একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। ১৯৪৭ উত্তর পর্যায়ে শুধু
ধর্ম ছাড়া অন্য কোন সাংস্কৃতিক যোগাযোগ পাকিস্তানের দু’ অঞ্চলে ছিল না।
তদানীন্তন শাসক গোষ্ঠী এ জন্য একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে
চেষ্টা করে। তাই তারা ইসলামিকীকরণ ও একত্রীকরণ নীতির কথা বলেন। এ নীতির
মূল কথা হলো-পূর্ব বাংলার মুসলমানরা খাঁটি মুসলমান নয়। এদের মধ্যে হিন্দু
সংস্কৃতির অশুভ প্রভাব রয়েছে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার আরো বুঝাতে
চেয়েছেন, উর্দু আরবী তথা ইসলাম ঘেঁষা ভাষা। উর্দু ভাষার মাধ্যমেই তাদেরকে
কোলকাতা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রভাব মুক্ত করা সম্ভব। মৌলানা সুলায়মান
নাথভী বলেন, ইংরেজ আমলে বাংলা সংস্কৃত অক্ষরে লেখা হতো। বাংলা ভাষা হতে
আরবী ও ফরাসী ভাষা বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দ ঢুকানো হয় এবং বাংলা ভাষা হিন্দু
উপাখ্যানের দ্বারা প্রভাবিত। এভাবে নানা কৌশলে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র
ভাষা করার ক্ষেত্র তৈরি করার চেষ্টা করে। অথচ সমগ্র পাকিস্তানের তিন ভাগের
দুই ভাগ অধিবাসী বাস করতো পূর্ব বাংলায় এবং তাদের প্রায় সকলের মাতৃভাষা
ছিল বাংলা। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বাকী এক ভাগ অধিবাসীরও মাতৃভাষা
উর্দু ছিল না।
উপরোক্ত তথ্য দেখে বলা যায়, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিকসহ সকল ক্ষেত্রেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী অগণতান্ত্রিক রীতি নীতি
অনুসরণ করেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব
বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি নিপিড়িত নিষ্পেষিত বাঙালি জাতিকে ধীরে ধীরে
সংগঠিত করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ এর জন্য যখন যা দরকার তাই করেছেন।
বলে
রাখা ভাল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে
পড়ার সময় থেকেই। সে বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার
মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার
প্রধানমন্ত্রী এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধু স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবীর উপর
ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাঁর কাছে যান। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র
ফেডারেশনে যোগ দেন তিনি। সেখানে তিনি এক বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত
হয়েছিলেন। ১৯৪২ সনে এনট্র্যান্স পাশ করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আইন
পড়ার জন্য ভর্তি হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ
নামকরা ছিল। এই কলেজ থকে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে
তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর
নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম
ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে শেখ মুজিব বিশেষ ভূমিকা পালন
করেন। এর দুই বছর পর ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের মহাসচিব নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালে অর্থাৎ দেশ বিভাগের বছর মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে
ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করে। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময়ে
কলকাতায় ভয়ানক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। এসময় মুজিব মুসলিমদের রক্ষা এবং
দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায়
শরিক হন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে
ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারির ৪
তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যার মাধ্যমে তিনি
উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।
১৯৬৮ সালের প্রথম
দিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি
কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলা নামে পরিচিত। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছিল শেখ মুজিবসহ এই কর্মকর্তারা
ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে এক
বৈঠকে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এতে শেখ
মুজিবকে এক নম্বর আসামি করা হয় এবং পাকিস্তান বিভাগের এই ষড়যন্ত্রের মূল
হোতা হিসেবে অখ্যায়িত করা হয়। অভিযুক্ত সকল আসামিকে ঢাকা সেনানিবাসে
অন্তরীণ করে রাখা হয়। এর অব্যবহিত পরেই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী
প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সর্বস্তরের মানুষ শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলের মুক্তির
দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির ৫ তারিখে কেন্দ্রীয় ছাত্র
সংগ্রাম পরিষদ তাদের এগার দফা দাবি পেশ করে যার মধ্যে শেখ মুজিবের ছয় দফার
সবগুলোই দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়।
এই সংগ্রাম এক সময় গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণআন্দোলনই ঊনসত্তরের
গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। মাসব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৪৪
ধারা ভঙ্গ, কারফিউ, পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং বেশ কিছু হতাহতের পর আন্দোলন যখন
চরম রূপ ধারণ করে তখন পাকিস্তান সরকার ছাড় দিতে বাধ্য হয়। তৎকালীন
রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের সাথে এক গোলটেবিল বৈঠকের পর এই
মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এবং শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলকে মুক্তি দেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের
সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল
জনসভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি
প্রদান করা হয়। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী
উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে
“বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হবে। তিনি বলেন, “একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর
মানচিত্র থেকে “বাংলা” শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো
হয়েছিল। “বাংলা” শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে
পাওয়া যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই
দেশকে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে “বাংলাদশ” ডাকা হবে। মুজিবের এই ঘোষণার ফলে
সারা দেশে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ এবং সামরিক
কর্তারা তাঁকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করতে শুরু করে।
মুজিবের বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ প্রাদেশিক
স্বায়ত্বশাসনের বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। অনেক বুদ্ধিজীবীর মতে, এ
আন্দোলন দ্বিজাতি তত্ত্বকে অস্বীকার করার নামান্তর। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের
মাধ্যমেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। বাঙালিদের জাতিগত ও
সংস্কৃতিগত এই আত্মপরিচয় তাদেরকে একটি আলাদা জাতিসত্ত্বা প্রদান করে। মুজিব
পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হন এবং কার্যত ভারতীয়
উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের শেখ
মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা
অর্জন করে। নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মেরুকরণ সৃষ্টি
করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো,
মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধীতা করেন। ভুট্টো এ্যাসেম্বলি
বয়কট করার হুমকি দিয়ে ঘোষণা দেন যে, ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য
আহ্বান জানালে তিনি সে সরকারকে মেনে নেবেন না। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার
মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ ডাকতে দেরি করেছিলেন। বাঙালিরা এতে বুঝে ফেলে যে,
মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে
সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন। এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান
সামরিক আইন জারি করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামী
লীগের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী
রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে।
সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে, মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূল ঘোষণার অনুবাদ নিম্নরূপঃ “এটাই হয়ত
আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান
জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর
বিরুদ্ধে শেষ প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ
পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত
আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক”। এরপর মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তান
নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত অভিযান অল্প
সময়ের মধ্যেই হিংস্রতা ও তীব্র রক্তপাতে রূপ নেয়। রাজাকারদের সহায়তায়
পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন
নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে। যুদ্ধবর্তী সময়ে মুজিবের পরিবারকে
গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তাঁর সন্তান শেখ কামাল মুক্তি বাহিনীর একজন
গুরুত্বপূর্ণ অফিসার ছিলেন। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত
যুদ্ধটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সরকার
বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনী ও
ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ দলের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানী শাসকবৃন্দ
মুজিবকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তিদান করে। এরপর তিনি ল-ন হয়ে নতুন
দিলিতে ফিরে আসেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ
করার পর জনসমক্ষে “ভারতের জনগণ, আমার জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু” বলে তাঁকে
সাধুবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে
আসেন।
দেশে ফিরে এসে তিনি বসে থাকেননি। শেখ মুজিবর রহমান বৃহৎ
রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের পর জাতিসংঘ ও জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে
বাংলাদেশের সদস্যপদ নিশ্চিত করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও
অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ভ্রমণ করে বাংলাদেশের জন্য মানবীয় ও উন্নয়নকল্পের
জন্য সহযোগিতা চান। তিনি ভারতের সাথে একটি বন্ধুত্বের চুক্তি স্বাক্ষর করেন
যাতে অর্থনৈতিক ও মানব সম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক সাহায্যের আশ্বাস দেয়া হয়।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি কর্তা
ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মুজিব ইন্দ্রিরা গান্ধির সাথে
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন। মুজিব তাঁর অন্তরবর্তী সংসদকে একটি নতুন
সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেন এবং চারটি মূলনীতি হিসেবে “জাতীয়তাবাদ,
ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র” ঘোষণা করেন। মুজিব শতাধিক
শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানী রাষ্ট্রীয়করণ করেন এবং ভূমি ও মূলধন বাজেয়াপ্ত
করে ভূমি পুনর্বন্টনের মাধ্যমে কৃষকদের সাহায্য করেন। ১ কোটি শরণার্থীর
পুনর্বাসনের জন্য বড় ধরনের পদক্ষেপ নেন। এর ফলে অর্থনৈতিক সংকট কমে যেতে
শুরু করে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা, স্যানিটেশন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানি ও
বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের বিস্তৃতি ঘটান। ১৯৭৩
সালে প্রকাশিত পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনায় কৃষি, গ্রামীণ অবকাঠামো ও কুটির
শিল্পে রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দেয়া হয়। মুজিব ব্যক্তিগত ও
রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ের মাধ্যমে ইসলামি অনুশাসনের পথে অগ্রসর হন। ১৯৭২ সালে
নিষিদ্ধ হওয়া ইসলামিক একাডেমি পুনরায় চালু করেন। বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন অফ
দি ইসলামিক কনফারেন্স ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্যপদ গ্রহণ করে।
মুজিব ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন।
পাকিস্তানের
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সকল প্রকার
বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বাঙালিদের আন্দোলনকে স্বাধীনতার পথে ধাবিত
করার জন্য বঙ্গবন্ধু অমর হয়ে আছেন। বাঙালির হাজার বছরের এ শ্রেষ্ঠ সন্তানের
প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। অমিত সম্ভাবনাময় আমাদের এ দেশ। এখানে যদি
বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করে মননশীলতা ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা
যায়, পৃষ্ঠপোষকতা করা যায় , আমাদের চৈতন্যকে প্রসারিত করা যায়, নতুন
প্রজন্মকে জ্ঞানের অবারিত ভান্ডারের সন্ধান দেয়া যায় তাহলে নিশ্চয়ই
বাংলাদেশ আলোকিত ও আধুনিক সমাজ এবং রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। তবে এ জন্য
একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ, মননশীল,
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ
সকলকে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্ভুদ্ধ হয়ে, দেশপ্রেমে
উজ্জীবিত হয়ে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে সমাজের প্রতিটি
স্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এ দিনটি বাংলাদেশের
¯্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর বছরে
তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখকঃ অধ্যক্ষ, কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড সরকারি মডেল কলেজ।