পবিত্র শবে বরাতের আমল ও তাৎপর্য
Published : Friday, 26 March, 2021 at 12:00 AM
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির ।।
মুমিন
বান্দার জন্য প্রতিটা সময়, দিবসই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইবাদত-
বন্দেগির সুবর্ণ সুযোগ। তেমনি এক গুরুত্বপূর্ণ মাস হল শাবান। শাবান মাসের
১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে
এসেছে। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী । ‘শবে
বরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারকাত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা
শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে।
অনেক দেশে ফারসি, উর্দু,
বাংলা, হিন্দিসহ নানান ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত।ইসলামের
দৃষ্টিতে যেসব দিবস ও রজনী বিখ্যাত, এর মধ্যে পাঁচটি রাত বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য। এই বিশেষ পাঁচটি রাত হলো: দুই ঈদের রাত্রিদ্বয়, শবে মিরাজ,
শবে বরাত ও শবে কদর।আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের,
নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী।
যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়
আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব
জানেন। তিনি নভোম-ল, ভূম-ল ও এই উভয়ের মাঝে যা আছে সেসবের রব।
যদি
তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু
দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবু তারা সংশয়ে
রঙ্গ করে। তবে অপো করো সেদিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধূআ★চ্ছন্ন হবে।
(সুরা দুখান,আয়াত-৪৪ -৬৪।
মুফাসসিরিনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুল
মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে।
(তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)।
হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখানের দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবে বরাত বোঝানো হয়েছে।
শবে বরাতের ফজিলত:
হজরত
আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো,
তিনি ইহ্জগতে নেই। আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর
বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে ল করে
বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া
রাসুলুল্লাহ (সা.)! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি ইহজগৎ
ত্যাগ করেছেন কি না? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।
তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা হলো অর্ধশাবানের
রাত; এ রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন;
মাপ্রার্থনাকারীদের মা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর
বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খ-,
পৃষ্ঠা ৩৮২)।হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের
জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার
পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ মা করে দেন। (তিরমিজি শরিফ,
হাদিস: ৭৩৯)।
যেভাবে ইবাদত করলে ভালো হয়:
শবে বরাতের নফল নামাজ ও
ইবাদত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন শাবানের
মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে।
(ইবনে মাজাহ)। ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নামাজ; সুতরাং নফল ইবাদতের মধ্যে
শ্রেষ্ঠ হলো নফল নামাজ। প্রতিটি নফল ইবাদতের জন্য তাজা অজু বা নতুন অজু করা
মোস্তাহাব। বিশেষ ইবাদতের জন্য গোসল করাও মোস্তাহাব। ইবাদতের জন্য দিন অপো
রাত শ্রেয়। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি
ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো; কেননা, এদিন সূর্যাস্তের
পর আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন; কোনো
মাপ্রার্থী আছ কি? আমি মা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব;
আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা
মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ,
হাদিস: ১৩৮৪)।
শবে বরাতের নফল রোজা:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসে, তখন তোমরা রাতে নফল
ইবাদত করো ও দিনে রোজা পালন করো। (সুনানে ইবনে মাজাহ)। এ ছাড়া প্রতি মাসের
১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজ-এর নফল রোজা তো রয়েছেই। যা আদি পিতা হজরত আদম
(আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম –ও পালন করতেন; যা মূলত সুন্নত। সুতরাং তিনটি রোজা রাখলেও শবে
বরাতের রোজা এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে
রজব (রা.) বলেন, এদিনের রোজা আইয়ামে বিজ, অর্থাৎ চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫
তারিখের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১৫১)।এ ছাড়া মাসের
প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ; শবে কদরের
রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি বা হজরত দাউদ (আ.)-এর পদ্ধতিতে এক দিন পর
এক দিন রোজা পালন করলেও সর্বোপরি প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয়; এবং শবে
কদরের রোজা এর শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম রমজান মাসের পর রজব ও শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা
পালন করতেন; শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো
আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মোমেনিন বা মোমিন মাতাগণ বর্ণনা করেছেন,
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু
করতেন মনে হতো তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)।পবিত্র শবে বরাত
সম্পর্কে কোরআনুল কারীমে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও হাদীস শরিফে
সুস্পষ্টভাবে এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফযিলত সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এ সকল
বর্ণনার মধ্যে কিছু বর্ণনা সম্পর্কে পৃথিবীর সকল মুহাদ্দিসীনে কেরাম সহিহ
বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিছু বর্ণনা হাসান, কিছু যয়িফ বলেছেন। একথা সত্য যে
কোনো বিষয়কে প্রমাণের জন্য একটি সহিহ হাদীসই যথেষ্ট।আর এ বিষয়ে
মুহাদ্দিসীন, ফুকাহা ও অন্যান্য ওলামায়ে-কেরামের অধিকাংশ একমত যে, ফযিলতের
েেত্র যয়িফ হাদীসের ওপর আমল করা জায়েজ এবং ‘যয়িফ’ সনদের হাদিস দ্বারাও
কোনো আমল মুস্তাহাব হওয়া প্রমাণিত হয়। তাছাড়া হাদিসে শবে বরাত পালন বা
ফযিলতের বিপে কোনো বর্ণনার প্রমাণও নেই। মন্তব্য – মহামারী করোনা ভাইরাস
সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে উপরোক্ত ইবাদাত ঘরে করাই শ্রেয় এবং আসন্ন
মাহে রমজানকে স্বাগত জানাতে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি।
লেখকঃ ইসলাম ও সমাজসচেতন লেখক, সংগঠক এবং চেয়ারম্যান - গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা। মোবাইল ০১৭১৮-২২৮৪৪৬