
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ||
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব সামাল দিতে আমরা দেখছি ১৪ এপ্রিল থেকে সার্বিক কার্যাবলি ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে সর্বাত্মক লকডাউন। এতে জরুরি পণ্য ও সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত কার্যক্রমের বাইরে সবকিছু বন্ধ রাখা হয়েছে। এই লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে এবং ইতোমধ্যে শপিংমল খোলার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার। লকডাউনের কারণে দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়েছেন নতুন করে।
আমরা দেখছি, ইতোমধ্যে মহামারি সংক্রমণের এক বছর পার হয়েছে। কিন্তু ঋণের জালে জড়িয়ে এবং সঞ্চয় হারিয়ে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখনও তাদের দৈনন্দিন জীবন চালাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। বিশেষ করে শহুরে বস্তিবাসীদের অবস্থা বেশ ভয়াবহ। আমাদের গবেষণায় এসেছে, শহুরে বস্তিতে কভিড-পূর্ব অবস্থার আয়ের চেয়ে এখনকার আয় ১৪% কম।
আমরা জানি, মহামারির কারণে অর্থনৈতিকভাবে তিগ্রস্ত হয়েছে নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ। এদের মাঝে আছে হতদরিদ্র এবং মাঝারি দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। এদের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। এ ছাড়া রয়েছে দরিদ্র নয় কিন্তু ঝুঁকিতে থাকা একশ্রেণির মানুষ যারা ভালনারেবল নন পুওর বা ভিএনপি। দেখা গেছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরে কিন্তু মধ্যম জাতীয় আয়সীমার নিচে থাকা এই শ্রেণির মানুষদের অবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে সবচেয়ে ধীরগতিতে। গত জুনে দরিদ্র নয় কিন্তু সেই ঝুঁকিতে থাকা এই মানুষদের ৭২% দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল। তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছিল 'নতুন দরিদ্র' হিসেবে। সেই 'নতুন দরিদ্র'দের অর্ধেকই এখনও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের তালিকায় বিদ্যমান। এই হার শহরে যত বেশি এবং গ্রামে তার তুলনায় কম। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে দেখলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। গত বছর সাধারণ ছুটির সময় মানুষকে মানবিক সহায়তা দিতে বেসরকারি সংস্থাগুলো নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। এবার সেসব উদ্যোগ তেমন দেখা যাচ্ছে না। নতুন দরিদ্রদের জন্য তাই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই।
বস্তুত দেশের বর্তমান দারিদ্র্য পরিস্থিতি যা, তাতে সামাজিক সুরা কর্মসূচি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক সুরা কর্মসূচির পাশাপাশি আরও নতুন কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, তা-ও সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ৩৫ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার করে টাকা এককালীন দেওয়া হবে এবং তিগ্রস্ত এক লাখ কৃষককে দেওয়া হবে পাঁচ হাজার করে টাকা। এই নগদ অর্থ সহায়তা যেন প্রকৃত দরিদ্রদের হাতেই পৌঁছায়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায় থেকেও দরিদ্রদের প্রতি মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ আসা উচিত বলে মনে করি আমরা। করোনাকাল কতটা দীর্ঘায়িত হবে, তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের দারিদ্র্যের চিত্র আরও খারাপ হতে পারে। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিন্তা মাথায় রেখেই সরকারকে তার পরিকল্পনা সাজাতে হবে।
যদিও কর্মসংস্থানের েেত্র বিগত জুন মাস থেকে উন্নতি ল্য করা যাচ্ছে। তার পরও কভিডের পূর্বে কাজ ছিল কিন্তু এখন বেকার এমন মানুষ রয়েছে ৮%। কর্মহীনতার এই ধারা নারীদের জন্য বেশ আশঙ্কাজনক। কভিডের আগে কর্মজীবী ছিলেন এমন নারীদের এক-তৃতীয়াংশ গত বছর জুন মাস থেকে এখনও বেকার। পুরুষদের েেত্র এই হার নেমে এসেছে ১৬% থেকে ৬%-এ।
স্বল্প আয় এবং বেকারত্বের পাশাপাশি কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধারের প্রকৃতি বদলে যাওয়াটাও একটি বড় চিন্তার বিষয়। কভিডের কারণে অনেককেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এদের অধিকাংশই 'অদ শ্রমিক' হিসেবে নতুন পেশা গ্রহণ করেছে। যেমন- অনেক েেত্র দ শ্রমিক, বেতনভুক্ত কর্মী এবং কারখানার কর্মীরা দিনমজুর হিসেবে কাজ শুরু করেছে।
কেবল কৃষি খাতই বলা চলে কভিড-পূর্ব অবস্থার মতো ইতিবাচক অবস্থান গড়তে পেরেছে। শহরে আয়ের সুযোগ হ্রাস পাওয়ায় বস্তি থেকে গ্রামে চলে যাওয়ার ঘটনা প্রচুর ঘটেছে। গত বছর ২৭.৩% বস্তিবাসী শহর ছেড়েছিল যাদের ৯.৮% এখনও ফেরেনি। প্রাক-কভিড অবস্থার তুলনায় আয় কমলেও খাবারের ব্যয় বাদে দৈনন্দিন যে ব্যয়, সেটি গত জুন থেকে দ্বিগুণ হয়েছে। ভাড়া বাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রদের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমে গেছে আশ্চর্যজনকভাবে। ভিএনপি এবং দরিদ্র নয় এমন শ্রেণির মানুষদের সঞ্চয়ের পরিমাণ কভিড-পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে সব শ্রেণিতেই ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
যদিও কভিডকালে সামাজিক সুরা নামমাত্র বা টোকেন ভূমিকা পালন করছে, কিন্তু এটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। শহরের দরিদ্র শ্রেণি এবং ‘নতুন দরিদ্র’দের জন্য বর্তমানে থাকা সুরা কর্মসূচির পাশাপাশি কার্যকরী ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন ও তাৎপর্যপূর্ণ আরও কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত। নতুন আয়ের ধাক্কা সামলাতে 'স্মার্ট' লকডাউন দরকার। এটি স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারও বটে।
দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়া নারী ও 'নতুন দরিদ্র'দের সহায়তা করা জরুরি। সিএসএমইসহ অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়া খাতগুলোতে একটি পরিকল্পিত এবং 'জোর ধাক্কা' দেওয়া প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, অতিদ্রুত একটি জাতীয় সিএসএমই পুনরুদ্ধার কর্মসূচি প্রণয়নও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
গত বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, এ ধরনের লকডাউনে সবচেয়ে বেশি তির মুখে পড়েছেন দিনমজুর, শ্রমিক ও নি¤œবিত্ত জনগণ। বিশেষ করে যারা শহর ও শহরের উপকণ্ঠে থাকেন। এ পরিস্থিতিতে অনানুষ্ঠানিক খাতের লোকজন রিকশাচালক, পরিবহনকর্মী, হকার, দিনমজুর, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কামার, কুমার, জেলে, দর্জি, বিভিন্ন ধরনের মিস্ত্রি, নির্মাণ শ্রমিকসহ দৈনন্দিন আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষ কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। সামগ্রিকভাবে নি¤œ আয়ের মানুষের ওপর লকডাউনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আয় হারিয়ে কর্মহীন বসে থাকার ফলে এ ধরনের মানুষের খাদ্য সংকট ছাড়াও স্বাস্থ্য ও মানসিক পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতিরও আশঙ্কা রয়েছে।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমরা সংক্রমণ এলাকাভেদে ‘স্মার্ট লকডাউনের’ কথা বলেছি। করোনা সংক্রমণের হার ও মাত্রাভেদে সারাদেশকে এককভাবে লকডাউনের আওতায় আনার দরকার নেই। বরং ‘হটস্পট’ তথা উচ্চ সংক্রমণ এলাকার কথা বিবেচনা করে নির্দিষ্ট স্থানে লকডাউন দেওয়া যেতে পারে। ঢাকাকে প্রধান সংক্রমণকেন্দ্র হিসেবে রেখে, চট্টগ্রাম ও উচ্চ সংক্রমণের অন্যান্য শহুরে এলাকাকে পৃথক এলাকা এবং উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলগুলোকে আলাদা করে বিভাজিত করা যায়। স্মার্ট লকডাউন কার্যকর করতে পরিবহন শ্রমিকদের আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা করে আন্তঃজেলা গণপরিবহনে বিধিনিষেধ কঠোর করা, মার্কেট সার্বিকভাবে বন্ধ না করে দিনের নির্দিষ্ট সময় খোলা রাখা, শহুরে বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে নিষেধাজ্ঞা কঠোর করা, যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাসায় থেকে কাজের সুযোগ আছে, সেগুলোতে 'ওয়ার্ক ফর্ম হোম' চালু করলে মানুষের আয়ের পথ বন্ধ হবে না। অন্যদিকে করোনা মোকাবিলাও সহজ হবে।
চেয়ারপারসন, ব্র্যাক ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা