ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
Published : Wednesday, 28 April, 2021 at 12:00 AM
 
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে এমন জাতীয় সংকট কখনও মোকাবিলা করেনি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্ব এতে প্রভাবিত হয়েছে। এ কারণে সংকট মোকাবিলার বিভিন্ন উদ্যোগ ও কৌশল গতানুগতিক হলে চলবে না।

গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে গেলে সরকার লকডাউনের আদলে দুই মাসের বেশি সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এ সময় মানুষ কাজ হারায়। বিশাল অঙ্কের মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। শ্রমবাজার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে কাজ না পেয়ে শহর থেকে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হন। এর মধ্যে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন সহায়তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এর ফলে গত বছরের শেষে এবং এ বছরের প্রথম দিকে এক ধরনের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে এবং অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসার পথে ছিল।

কিন্তু গেল মার্চ থেকে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবার সংকটের মুখে পড়েছি আমরা। বিশেষত যারা আগে থেকেই দরিদ্র এবং নতুন করে যারা দারিদ্র্যের কবলে পড়েছেন, তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। গত এক বছর ধরে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তাদের কাছে থাকা কৌশলগুলো ব্যবহার করে ফেলেছেন। সঞ্চয় ভেঙেছেন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছেন। সরকারি সহায়তা যতটুকু পেয়েছেন, তা কাজে লাগিয়েছেন। অনেকেই হয়তো সরকারি সহায়তা পাননি। অনেকে কম খেয়ে, শিা বা স্বাস্থ্যে কম ব্যয় করে বিভিন্ন কৌশলে টিকে থেকেছেন। টিকে থাকার এসব সামর্থ্য বা কৌশল এখন শেষ হয়ে গেছে।

এখনকার যে নতুন ধাক্কা, তা সামাল দিতে সরকারের পাশাপাশি সামর্থ্যবানদের একটা সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এ সময়ে সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা অন্যান্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি আমরা এক ধরনের মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হতে পারে। এ কারণে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা বা তাদের বিভিন্ন উদ্যোগ বিভিন্ন কারণে জরুরি।

আমরা দেখেছি, গত বছর সরকারের বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা বা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুফল অনেকের কাছে পৌঁছায়নি। গত বছর প্রধানমন্ত্রী ৫০ লাখ পরিবারকে ২৫০০ টাকা করে অনুদান দেওয়ার সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, নানা কারণে বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, তথ্যের অপর্যাপ্ততা, দুর্নীতিসহ নানা কারণে প্রায় ১৫ লাখ পরিবারে এই টাকা পৌঁছানো যায়নি। পুরো প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধিকে সেভাবে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আমলতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজটি করা হয়েছিল। এখন ৩৫ লাখ পরিবারকে আবার ২৫০০ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আমার মনে হয়, একজন জনপ্রতিনিধি তার এলাকা সম্পর্কে ভালো জানেন এবং তার পে এখনকার তিগ্রস্তদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব। মন্ত্রণালয়ে বা সরকারের প্রশাসনে যারা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয় না করা গেলে আবার এই মহৎ উদ্যোগ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নাও হতে পারে। সুতরাং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা খুবই জরুরি। দরিদ্রদের কাছে সরকারের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য এবং পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন, যাতে এক ধরনের 'চেক অ্যান্ড ব্যালান্স' থাকে। এর মানে একজন আরেকজনকে তদারকি করবে। তা না হলে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা বিতরণে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হবে। জনপ্রতিনিধি, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সবার সম্পৃক্ততা এবং সবার মধ্যে সমন্বয় থাকলে সরকারের সহায়তা বিতরণ সুশৃঙ্খল হবে। আর সমন্বয়ের জায়গায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবশ্যই নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকায় থাকতে হবে।

গত অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ করোনা মোকাবিলার জন্য প্রস্তাবনা রাখা হয়েছিল। কিন্তু তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল করোনাকালে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার করা, যাতে এরকম পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাত তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে। করোনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্ম হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। সংকটকালে তাদের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সামাজিক সুরা কর্মসূচিতে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি বাজেটের আগেই বড় ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও পরে তা বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু গত এক বছরে এসব প্রস্তাবনা নিয়ে জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিদের তেমন আলোচনা করতে দেখা যায়নি। জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে সহযোগিতা পৌঁছাচ্ছে কিনা, সেখানে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ঘটছে কিনা এবং ুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা প্রণোদনার সহযোগিতা পাচ্ছেন কিনা- এসব বিষয়ে জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিদের সুনির্দিষ্ট ও প্রাণবন্ত কোনো আলোচনা করতে দেখা যায়নি।



জনপ্রতিনিধিরা যদি এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা না করেন তাহলে সংকটকালে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হওয়ার েেত্র বাধার সম্মুখীন হতে পারে। এর প্রতিফলন এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য অতিরিক্ত যে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, তার কিছুই ব্যয় হয়নি। এমনকি সামাজিক সুরা কর্মসূচির আওতায় ৫০ লাখ পরিবারকে সহযোগিতা প্রদানের কথা থাকলেও ৩৫ লাখের বেশি পরিবারকে সহযোগিতা করা যায়নি। প্রশ্ন থেকে যায়, অনেক জনপ্রতিনিধি জনগণের দাবিগুলো উত্থাপন করতে পারছেন না বা উত্থাপন করছেন না।

সুতরাং আগামী জুনে নতুন যে বাজেট উপস্থাপন করা হবে, আশা করি সংসদ সদস্যরা বাজেট আলোচনায় এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। সংকট মোকাবিলায় সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেসব উদ্যোগ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বা কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না, কোন কোন এলাকা পিছিয়ে আছে- এসব বিষয়ে তারা যথেষ্ট আলোচনা করবেন এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় বের করবেন। আগামী বাজেটে সংকট মোকাবিলায় যে উদ্যোগগুলো থাকবে, সেগুলো যেন বাস্তবসম্মত হয় এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করার েেত্র যেসব চ্যালেঞ্জ থাকবে, সেগুলোকে কীভাবে অতিক্রম করা যায়- জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়েও আলোচনা করতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের উচিত সরকারের এ ধরনের উদ্যোগে সম্পৃক্ত হয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। আগামী বাজেট সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, জনপ্রতিনিধিরা এই বাজেট কার্যকর করতে তাদের ভূমিকা পালন করবেন।

এই অভূতপূর্ব সংকট সরকারের পে এককভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। জনপ্রতিনিধি, সংবাদমাধ্যম এবং অন্যান্য অংশীজন সঙ্গে নিয়ে সরকারকে সমন্বিতভাবে এ সংকট মোকাবিলা করতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, সানেম