অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
জাতিসংঘের (এফএও)’র হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ২০০০-২০১৫ সময়কালে প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। বাংলাদেশে তা ২.৬ শতাংশ। বাংলাদেশে বছরে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বন উজাড় হয়। উজাড় হওয়া থেকে সংরক্ষিত বন সুন্দরবনের বিস্তারও ঘনত্ব উভয়ই কমছে। বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, গত দুদশকে (২০০০-২০২০) সুন্দরবনের গাছপালার পরিমাণ মারাত্মক হারে কমেছে। বন উজাড় হয়ে ফাঁকা বা পতিত জমির পরিমাণ বাড়ছে। সুন্দরবনের বিস্তার প্রায় অর্ধেকে নেমে আসছে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ অংশের পুরো বনের বিস্তার ছিল ১৭ হাজার কিলোমিটার। ২০১৬ সালের হিসাব অনযায়ী বাংলাদেশ অংশের পুরো বনের বিস্তার ৬ হাজার ৪৬৭ কিলোমিটার। সংরক্ষিত বনের যদি এ দশা হয় তাহলে অসংরক্ষিত বনাঞ্চলের কি অবস্থা।
গত দশ বছরে সুন্দরবনে প্রায় সাতগুণ দূষণ বেড়েছে বলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের এক গবেষণা তথ্যে জানা যায়। বন এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন, যান্ত্রিক নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নানা কারনে দূষণ বাড়ায় সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদীর পানিতে তেলের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০.৮ মিলিগ্রাম। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ মিলিগ্রাম। যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা হল ১০ মিলিগ্রাম। পানি ও মাটিতে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক জায়গায় আগের মত আর চারাগাছ গজাচ্ছে না। যে সব রুটে নৌযান চলাচল করে ঐ রুটগুলোর বনের পাশে এখন আর তেমন হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী দেখা যায় না।
সম্প্রতি পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বন বিভাগের উপস্থাপিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী সারাদেশে ২,৫৭,১৫৮ একর বনভূমি দখল হয়ে গিয়েছে। ১,৬০,৫৬৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান এসব বনভূমি জবরদখল করে রেখেছেন। জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে কলকারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী দখলদারদের মধ্যে ৮৮,২১৫ জন ১,৩৮,৬১৩.০৬ একর সংরক্ষিত বনভূমি দখল করেছেন। ৮২০ একর সংরক্ষিত বন দখল করে স্থায়ী স্থাপনাসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা করেছেন ১৭২জন। ৪,৯১৪ একর বন দখল করে ৩,৩২৯ জন গড়েছেন হাটবাজার, দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কটেজ, ফার্ম, রিসোর্ট ইত্যাদি। ঘরবাড়ি করেছেন ৫৮,৪০৭ জন। স্থায়ী স্থাপনা না করে কৃষিকাজ, বাগান ইত্যাদি করেছেন ২৬,৩০৭ জন।
এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সরকারি বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন কাজে পাহাড়-টিলা কাটা বা অন্য কোন উপায়ে ভূমিরূপ পরিবর্তন করা যাবে না বলা হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় কাটা চলছেই। ফলে পাহাড়, বন ও পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী উপকূলের নীচু এলাকা সাগরের লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি-পানি ক্রমেই লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলার কারণে নতুন নতুন অনুজীব আমাদের চারপাশের পরিবেশ অবমুক্ত হচ্ছে। ফলে কভিড’১৯ এর মত আরও নিত্যনতুন রোগের সংক্রমণ শুরু হতে পারে বলে আশংকা আছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বনভূমি বৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের বিকল্প নাই। বন স্বাস্থ্যকর বাতাস, পুষ্টিকর খাবার, পরিস্কার পানীয় জল, বিনোদন ইত্যাদির উৎস। উন্নত দেশগুলোতে ২৫ শতাংশ ঔষধের কাঁচামাল উদ্ভিদ থেকে আসে। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ অবদান ৮০ শতাংশের বেশী। সুতরাং সুস্থ্য জীবন ধারনের জন্য বনের জীবন বাঁচানো অত্যাবশ্যক। আইনের তোয়াক্কা না করে সংরক্ষিত এলাকাগুলোর মধ্যেই উন্নয়ন বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনের যুগোপযোগীকরণ ও যথাযথ বাস্তবায়ন করা না গেলে বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। বন আইনের যোগপোযোগী করে যথাযথ বাস্তবায়ন করা না গেলে বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের কাজ সম্ভব নয়। বন আইনের যুগপোযোগী করণ ও প্রয়োগ দরকার। প্রণীত খসড়া বন আইন ২০১৯ এর বিভিন্ন দিকের উপর সর্বসাধারণের মতামত চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকৃতিবিষয়ক সংগঠনগুলোর জোট আইইউসি বাংলাদেশের জাতীয় কমিটির পক্ষে মতামত ও প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। বন লালন ও সংরক্ষণে বনবাসী ও বনজীবীদের বিভিন্ন ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও প্রথাগত টেকসই পন্থাগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক বন ব্যবস্থাপনায় অর্ন্তভূক্তি দরকার। বনবাসী ও বনজীবীদের বিভিন্ন ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও প্রথার চর্চা বাড়াতে পারলে বন ও বনভূমি সংরক্ষণ ত্বরান্বিত হবে।
নির্বিচারে বন ধ্বংস, বিদেশি প্রজাতির গাছের অগ্রাসন, বাণিজ্যিক বন সম্প্রসারণ ও বনবিভাগের উদাসীনতার কারণে ক্রমেই ধ্বংসের পথে প্রাকৃতিক বন। প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ, বিনষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে হারিয়ে যাবে প্রাকৃতিক বন। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বন রক্ষায় এখনই উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী বনের আয়তন ৩,৩২,৩৩১ হেক্টর নির্বিচারে বন ধ্বংশ, বিদেশি প্রজাতির আগ্রাসন, প্রাকৃতিক বন উজাড় করে রাবার ও ফলজ বাগান তৈরি, বনের গাছ চুরির কারণে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বন। এছাড়া অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মানের কারণে বনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বন ধ্বংসের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে শত প্রজাতির বৃক্ষ, লতা-গুল্ম। বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
এসব নিয়ে বন বিভাগের কোন নজরদারি নাই। প্রাকৃতিক বন বিপন্ন হওয়ায় বিপন্ন হয়ে উঠছে বনের উপর নির্ভরশীল মানুষরা। বন ধ্বংস হওয়ায় পানির উৎস কমেছে প্রায় ৬১ শতাংশ। শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি ঝর্ণায় পানির উৎস কমে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ পাহাড়ই ন্যারা করে বনকে ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়া ইটভাটার জন্য নির্বিচারে অশ্রেণিভুক্ত বনের গাছ কাটা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বন শুন্য হয়ে যাবে।
প্রতিটি গাছ পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি গাছকে বাঁচাতেও উন্নয়ন নকশায় পরিবর্তনের নজীর আছে। ক্ষুদ্র পরিসরে বৃক্ষরোপন এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্পও পরিবেশে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। মানুষের মানসিক ও শারিরীক সুস্থতা, বায়ুদুষণ হ্রাস, পরিবেশ শীতলকরণ এবং বন থেকে অন্যান্য পরিসেবার গুণগত পরিমাণ বাড়াতে বনের জীবন বাঁচানো জরুরী। বন সংরক্ষনের মাধ্যমেই শোভন ও পরিবেশবান্ধব জীবিকার ব্যবস্থা হতে পারে। বন থেকে বিশ্বব্যাপী ৮৬ কোটিরও বেশি লোকের কাজের ব্যবস্থা হয়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা গেলে টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে দরকার স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্তকরণ ও ক্ষমতায়ন। বনবাসী এবং বনজীবিদের অংশ গ্রহণে সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রম অচিরেই চালু করা। ফলত: স্থানীয় জনগণই বনের জীববৈচিত্র রক্ষায় এগিয়ে আসবে। বনের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজ থেকেও বিরত থাকবে। সরকারি, বেসরকারি এবং স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রয়াশে বিভিন্ন বাস্তুসংসস্থানের জীববৈচিত্র রক্ষায় আইইউসিএনের টাঙ্গুয়ার হাওর, কক্সবাজার, নিঝুমদ্বীপসহ কয়েকটি প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে আরও সহব্যবসস্থাপনা প্রকল্পের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে গোটা দেশের বাস্তুসংসস্থানে ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব। দেশবাসীর নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই বন ও বনের জীববৈচিত্র রক্ষা অতীব জরুরী।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল