আবদুল মান্নান ||
১৯৭২ সালের অক্টোবর মাস। বাংলাদেশের বাতাসে তখনো বারুদের আর পচা লাশের গন্ধ। একজন মানুষ তাঁর বিশ্বস্ত কর্মীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এই বাংলাদেশকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাতে। সেই মানুষটি জাতির পিতা ও সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। তখনো বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হতে চেষ্টা করছে। ২৬ আগস্ট চীন ভেটো দিয়ে তা ঠেকিয়ে দিয়েছে। ১১টি দেশ জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সমর্থন করেছে আর তিনটি দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে। চীন আবিষ্কার করেছে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করার পেছনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তাদের মিত্র দেশ ভারতের হাত রয়েছে। ইরাক ছাড়া আর কোনো আরব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেয়নি। তারা সব সময় পাকিস্তানের বন্ধু থেকেছে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যখন বিশ্ব স্বীকৃতি আদায়, জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ, দেশ পুনর্গঠন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কান্তিহীনভাবে পরিশ্রম করছেন, বিশ্ব তখন দুই শিবিরে বিভক্ত। একটির নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যটির সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শেষে এটি ধারণা করা হয়েছিল, যুদ্ধ শেষে বিশ্বে আবার শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশিত শান্তির বদলে এই বিভক্তির কারণে বিশ্ব দেখল আরেক ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয় ঠা-া লড়াই। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এটি ধারণা করা হয়েছিল বিশ্বে মাত্র একটি পরাশক্তি আছে, কারণ তারা তাদের শক্তির প্রদর্শন করতে গিয়ে যুদ্ধের শেষ সময়ে এসে বিনা কারণে আণবিক বোমা মেরে জাপানের দুটি শহরই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেনি, হত্যা করেছে কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে। যুদ্ধ শেষে নতুন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন জানিয়ে দিল তারাও আণবিক শক্তি, তবে তা তারা শান্তির জন্য ব্যবহার করবে। এর পরও এই দুই পরাশক্তির মধ্যে বেশ অনেক দিন ধরে চলল অস্ত্র প্রতিযোগিতা। তখন সারা বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলো জোর গলায় আওয়াজ তুলল আর যুদ্ধ নয়, এবার শান্তি চাই। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু, ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট নক্রুমা, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুয়েকার্নো আর যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর প্রচেষ্টায় গঠিত হলো জোটনিরপে দেশগুলোর একটি প্ল্যাটফর্ম, যাদের মূল উদ্দেশ্য তারা মার্কিন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো দেশের বলয়ে থাকবে না। তারা সব সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। তবে এটা ঠিক এই প্ল্যাটফর্মকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনো সহজভাবে নেয়নি, কারণ এই জোটকে সোভিয়েত ইউনিয়নও সমর্থন জুগিয়েছে।
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু শান্তিকামী সুধীজন পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে বসে এক সভায় গঠন করলেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ। এই সময় যুক্তরাষ্ট্র কোরীয় যুদ্ধে পরোভাবে জড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। তখন পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের দেশের বাইরে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তপে করেনি। বিশ্ব শান্তি পরিষদ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তেমন কোনো মতপার্থক্য না থাকার কারণে তারা উভয়ই একই সঙ্গে শান্তির জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হলো। ১৯৫০ সালেই সিদ্ধান্ত হলো প্রতিবছর এই কাউন্সিল শান্তির জন্য ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করেন এমন সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তারা নোবেল শান্তি পুরস্কারের আদলে পদক দেবে, যা ফরাসি বিজ্ঞানী নোবেল লরিয়েট জুলিও কুরির (ঔবধহ ঋৎবফবৎরপ ঔঁষরড়ঃ ঈঁৎরব, ১৯০০-১৯৫০) ও তাঁর স্ত্রী নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানী মাদাম কুরির নামে হবে। তিনি নিজে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন (১৯৫০-৫৮)।
১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেই বছর সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে এই পদক দেওয়া হবে। কারণ তিনি আজীবন শান্তির জন্য লড়াই করেছেন। বিভিন্ন সময়ে এই পদকে ভূষিত হয়েছেন স্পেনের পাবলো পিকাসো, তুরস্কের নাজিম হিকমত, ভারতের মুলকরাজ আনন্দ, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, দণি আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি। সময়ের প্রোপটে বিচার করলে সেই সময় এই পদক পাওয়ার যোগ্যতা বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো ছিল না। কারণ তিনি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্মে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বারবার শান্তির প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় এশীয় শান্তি সম্মেলনে উপস্থিত থেকে এই পদক হস্তান্তর করেন বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ (১৯১৯-২০১৬)। পরে তিনি ১৯৭৭ সালে এই পরিষদের সভাপতি হন। রমেশ চন্দ আজীবন বামপন্থী রাজনীতি করেছেন, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং বিশ্বশান্তির প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ছিল প্রশ্নাতীত। বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া এই পদক ছিল বাংলাদেশের প্রথম কোনো একটি আন্তর্জাতিক পদক প্রাপ্তি ও স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুকে পদক পরিয়ে দিয়ে রমেশ চন্দ বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, তিনি আজ থেকে বিশ্ববন্ধুও বটে।’ ঠিক একইভাবে গত ২৭ জানুয়ারি নোবেল লরিয়েট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলে আয়োজিত বক্তৃৃতায় লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর জীবন, চিন্তাধারা ও কর্ম বিশ্লেষণ করে বলা যায় তিনি শুধু বাংলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা-ই নয়, তিনি ‘বিশ্ববন্ধু‘ বটে।”
পদক গ্রহণের পর শান্তি সম্মেলনে আসা উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “লাখো শহীদের রক্তে সিক্ত স্বাধীন বাংলার পবিত্র মাটিতে প্রথম এশীয় শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য আগত শান্তির সেনানীদের জানাই স্বাগতম। উপনিবেশবাদী শাসন আর শোষণের নগ্ন হামলাকে প্রতিরোধ করে ত্রিশ ল শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে গেছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি বিশ্বশান্তি তথা আঞ্চলিক শান্তিও অপরিহার্য।...এই সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতাসংগ্রামের বীর সেনানীদের, ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির। এটা আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুুষের।”
মুজিব জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ৪৮তম বছর আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পালিত হলো কয়েক সপ্তাহ আগে। এই সময়ে এসে এটি নির্দ্বিধায় আবারও বলা যায়, বঙ্গবন্ধু কোনো বিপ্লবী নেতা ছিলেন না। তিনি আজীবন রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে চেয়েছেন, সন্ত্রাস দিয়ে নয়। তিনি সব সময় বিশ্বাস করেছেন শান্তির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু যে শান্তির স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু আজীবন দেখেছেন সেই স্বপ্ন এখনো অধরা রয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালে তাঁকে হত্যা করে এ দেশে অশান্তির বীজ বপন করা হয়েছে। এখনো দেশের ভেতর একটি মহল সর্বদা অশান্তি সৃষ্টি করার কান্তিহীনভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে, যা বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী ঠেকিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা অজুহাতে শান্তি বিঘিœত হচ্ছে। ঘরের পাশের দেশ মিয়ানমারে হচ্ছে, পাকিস্তানে হচ্ছে, আফগানিস্তানে আবার সন্ত্রাসের ফেরিওয়ালা তালেবানদের হাতে চলে যাচ্ছে, পুরো মধ্যপ্রাচ্য অশান্তিতে জেরবার, ফিলিস্তিনে ইসরায়েল লাগাতরভাবে নিরীহ মানুষ হত্যা করে চলেছে, একই অবস্থা ইয়েমেনে ও আফ্রিকার অনেক দেশে। যেসব দেশে এমন অশান্তি চলছে তাদের পেছনে আছে বিশ্বের কোনো কোনো পরাশক্তি এবং এই সমর্থন একান্ত নিজস্ব স্বার্থে। মনে করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিশ্ব আর অশান্তি দেখবে না। বাস্তবে সেই আশা শুধু আশাই থেকে গেল। কারণ শান্তির প্রতি বিশ্বনেতাদের অনেকেরই অঙ্গীকার শূন্যের কোটায়। আজকের এই দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যেমন শান্তিপূর্ণ একটি দেশ, অঞ্চল এবং বিশ্ব দেখতে চেয়েছিলেন, তেমন একটি শান্তির জন্য দেশে ও দেশের বাইরে সবাইকে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি অমর হোক।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক