ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
তিউনিশিয়ায় উদ্ধার ৩৩, মাদারীপুরেরই ২৯ জন
Published : Monday, 24 May, 2021 at 12:00 AM
তিউনিশিয়ার উপকূলে নৌকাডুবির ঘটনায় ৩৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন ৫০ জন। জীবিত উদ্ধারদের মধ্যে ২৯ জন এবং নিখোঁজদের মধ্যে একজন মাদারীপুরের বিভিন্ন গ্রামের অধিবাসী।
ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে তারা লিবিয়ার জাওয়ারা উপকূল থেকে একটি নৌকায় অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাচ্ছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পুলিশ ও অভিবাসনপ্রত্যাশী পরিবারের স্বজন ও এলাকাবাসী।
ওই ঘটনার পর মানবপাচারকারীদের ধরতে মাঠে কাজ করছে পুলিশ। তবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চূড়ান্ত তালিকা না আসা পর্যন্ত প্রশাসন সঠিক তথ্য দিতে পারছে না।
পুলিশ ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ মে (রোববার) ৮৩ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী লিবিয়ার জাওয়ারা উপকূল থেকে একটি নৌকায় অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাচ্ছিল। ইউরোপে প্রবেশের সময় উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে।
নৌকাডুরি পর তিউনিশিয়ার সেনাবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে ৩৩ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে জীবিত উদ্ধার করে। নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ হয় ৫০ জন। জীবিত উদ্ধার ৩৩ জনই বাংলাদেশি এবং তাদের ২৯ জনের বাড়ি মাদারীপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে।
উদ্ধার বাংলাদেশিরা তিউনিশিয়ায় রয়েছে বলে তাদের পরিবারের কাছে মোবাইলে জানিয়েছে। তাদের মধ্যে সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের নয়ারচর একই গ্রামের ১৪ জন। বাকি ১৫ জন জেলার বিভিন্ন গ্রামের।
তারা প্রত্যেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা করে দিয়ে মহাসিন নামে এক আদম ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ইতালি যাচ্ছিল। এই আদম ব্যবসায়ীর বাড়িও জেলার নয়ারচর গ্রামে। এছাড়া নৌকাডুবির ঘটনায় যে ৫০ জন নিখোঁজ রয়েছে তাদের মধ্যে ১ জনের বাড়িও নয়ারচর গ্রামে। তার নাম সেন্টু মন্ডল।
গত কয়েক দিন ধরে ওই গ্রামের বাড়ি বাড়ি থেকে ভেসে আসছে শুধু কান্নার আওয়াজ। বৃহস্পতিবার রাতে ওইসব ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে একটু স্বস্তিবোধ করছেন পরিবারের লোকজন। তবে প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের ফিরে পাওয়ার শঙ্কায় পরিবারের মাঝে বিরাজ করছে অনিশ্চিয়তা আর হতাশা।
তবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চূড়ান্ত তালিকা না আসা পর্যন্ত প্রশাসন সঠিক তথ্য দিতে পারছে না।
ভূক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, নয়াচর গ্রামের মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য মহাসিন ইতালি নেয়ার কথা বলে প্রত্যেকের পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা করে নেয়। জমিজমা বিক্রি করে এবং ব্যাংক ঋণ নিয়ে মহসিনের হাতে টাকা তুলে দেয়।
তবুও ওইসব যুবক-কিশোর ইতালি যেতে পারেনি। অনেকে লিবিয়ার বন্দি শিবিরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে তাদের পরিবারের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করছে চক্র। অবৈধপথে বিদেশযাত্রার প্রবণতা বাংলাদেশের মধ্যে মাদারীপুর জেলায় বেশি।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একাধিক দালালচক্র। বিভিন্ন সময় একাধিক মামলা হলেও অদৃশ্য হাতের ইশারায় দালালচক্র বারবার রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয় তাও জানা যায় না।
নয়ারচর গ্রামের জীবিত উদ্ধার হওয়া এমরানের বড় ভাই সরোয়ার বলেন, ‘ধার দেনা ও বাড়ি বিক্রি করে আমার ভাইকে বিদেশে পাঠিয়েছি। আল্লাহ যেহেতু বাঁচিয়ে রেখেছে, তাই এই দেশ এবং ওই দেশের সরকারের কাছে দাবি আমার ভাইয়ের জন্য যেনো একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। আর যদি দেশে আসে তাহলে দেনার দায়ে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’
একই দাবি করেছেন জীবিত উদ্ধার হওয়া অভিবাসন প্রত্যাশী সকল পরিবার।
এদিকে নিখোঁজ সেন্টু মন্ডলের স্ত্রী সাথী আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর খোঁজ পাইনি। তিনি বেঁচে আছেন কি-না তাও জানি না। আমি এখন ৩ অবুঝ সন্তান নিয়ে কোথায় দাঁড়াব। দেনার টাকা কিভাবে দেব’।
নিখোঁজ সেন্টুর শ্বশুর আব্দুর রব বেপারী বলেন, ‘আমার তিনটি নাতি, অনেক কষ্ট করে; ধার দেনা করে সাড়ে ৭ লাখ টাকা দিয়ে আমার জামাইকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তার কোনো খোঁজ নাই। কি হবে আমার মেয়ে ও তাদের অবুঝ সন্তানদের।’
নয়ারচার এলাকার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘ঘরবাড়ি বিক্রি করে, ধার দেনা করে যারা একটু সুখের আসায় পরিবারকে ভালো রাখার জন্য ইতালি যাওয়ার পথে জীবিত উদ্ধার হয়েছে, তাদের সেই দেশে রেখে কর্মসংস্থান অথবা ইতালিতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি জানাই। পাশাপাশি নিখোঁজদের সন্ধান করে জীবিত অথবা মৃত তাদের পরিবারের কাছে প্রেরণ করারও দাবি জানাই।’
মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য মহাসিনের বাড়ি গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার ফুফু রহিমা বেগম বলেন, ‘আমার ভাতিজা সবার কাছে আগেই বলে নিয়েছে সাগরের বিষয় আমি দেখব না। এটা বলছে কিনা তাদের কাছে জেনে দেখেন। তাছাড়া মহাসিনও তো সেখানে উদ্ধার হয়েছে। তার মা ও পরিবার ঢাকা থাকে। মহাসিন অনেকদিন আগেই লিবিয়া গেছে।’
মাদারীপুর পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। উদ্ধার হওয়া যুবকেরা যাদের মাধ্যমে এই পথে গেছেন, সেই দালালদের আমরা নিহ্নিত করেছি। এ ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।’
এ ব্যাপারে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নিখোঁজ বা উদ্ধারের কোনো তালিকা এখন পর্যন্ত পাইনি। তবে দালালদের একটি তালিকা পুলিশ সুপারকে দিয়েছি। তারাই ব্যবস্থা নেবেন।