রেজানুর রহমান ||
এক অর্থে সবই তো এখন খোলা। ট্রেন, বাস, লঞ্চ-স্টিমার বন্ধ ছিল। এখন সবই খুলে দেওয়া হয়েছে। আকাশ পথ আগেই খুলেছে। হাট বাজার, অফিস আদালত চলছে যার যার মতো। পার্ক, রেস্তোরাঁ, বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ভিড় কমেনি এতটুকুও। বিয়ে, জন্মদিন, সংবর্ধনা জনসভাসহ সামাজিক সব ধরনের অনুষ্ঠান চলছে স্বাভাবিক গতিতে। শুধু বন্ধ আছে দেশের শিা প্রতিষ্ঠান। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় বারবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হচ্ছে। যদিও বুধবার শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘১৩ জুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারবো’।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে দেশের শিক্ষােেত্র চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। হাতে কোনও কাজ নেই। কথায় আছে ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’। হাতের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হাতছানি। একটি মোবাইল ফোন হাতে থাকা মানেই তাবৎ দুনিয়ার আনন্দ-বিনোদন, ভালো-মন্দ সবই নিজের দখলে থাকা। ফলে শিক্ষার্থীদের একটা বিরাট অংশ দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই মোবাইল ফোনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। কী শহর, কী গ্রাম সর্বত্র একই অবস্থা। একজন অভিভাবক বললেন, স্কুল বন্ধ থাকায় তার ছেলেমেয়েরা দিনে দিনে পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সারাণ মোবাইল ফোন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পড়াশোনার কথা বললেই রেগে যায়। সারা রাত জেগে থাকে। দিনে ঘুমায়। কিছু বলতে গেলেই নানা কথা শুনিয়ে দেয়। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ উদ্বিগ্ন এই অভিভাবক অনেকটা কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেন, সবই তো খোলা। তাহলে স্কুল খুলতে সমস্যা কোথায়? তিনি সরকারের উদ্দেশে বললেন, হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন, অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করুন।
করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে দেশের সব শিক্ষ প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এজন্য বড় সংকটে পড়েছে দেশের ৪০ লাখ ছাত্রছাত্রী। এরা বড় অংশ এসএসসি ও এইচএসসি পরীার্থী। সরকার অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার পরামর্শ দিলেও মফস্বলের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এখনও সৃষ্টি করা যায়নি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে দিনে দিনে হতাশা বেড়েই চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিােভ সমাবেশ হচ্ছে প্রতিদিন। অঙ্কের হিসাবে প্রায় ১৭ মাস বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী ও ৫০ লাখ শিক-শিকিা রয়েছেন। শিক-শিকিাদের মধ্যে যারা সরকারি স্কুল-কলেজে চাকরি করেন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও তারা নিয়মিত বেতন ভাতা-বোনাস পাচ্ছেন। বিপাকে পড়েছেন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক-শিকিারা। অনেকেই নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরও অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে নানা উপায়ে বেতন আদায় করছেন। ফলে অসন্তোষ বাড়ছে প্রতিদিন। অভিভাবকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কাজেই কেন শিক্ষার্থীরা বেতন দেবে? অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এর সন্তোষজনক জবাব না দিয়ে বরং ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। বেতন পরিশোধ না করলে ভর্তি বাতিল হয়ে যাবে এমন হুমকিও দিচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, দেশের সবই যখন খুলে দেওয়া হলো তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া সময়ের দাবি। সেেেত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। ইতোপূর্বে শিক-শিকিা ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য করোনার টিকা নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যদিও সবারই টিকা পাওয়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তাহলে কি টিকা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না? সে বিষয়টিও ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে পরিষ্কার করা দরকার।
একজন অভিভাবক বললেন, এমন তো নয় যে আমরা ছেলেমেয়েদের সব সময় ঘরেই রাখতে পারছি। বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে। নিজেরা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। বাজারে যাচ্ছে। বিনোদনমূলক নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে। করোনা সংক্রমণের েেত্র এই চর্চাগুলোই তো বেশি আশঙ্কার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে শিক্ষার্থীরা বরং একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে যাবে। তাদের হতাশা দূর হবে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগে শিক ও অভিভাবকদের একটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ জোর দিতে হবে। তা হলো স্বাস্থ্যবিধি। উপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন এই অভিভাবক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই দেখলাম একটি স্কুলের কাস রুমের মেঝেতে একটি চারা গাছ উঁকি দিয়েছে। এটি একটি প্রতীকী ছবি হতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বলেই কি শ্রেণিকসহ প্রতিষ্ঠানের নানান দিক দেখার কেউ নেই? শ্রেণিকরে মেঝে ফুঁড়ে চারা গাছ উঁকি দিলো। কেউ দেখলো না? এই যে না দেখার অভ্যাস এটাই একদিন আমাদের জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তরুণদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রতিবেদন, রিপোর্ট প্রচার ও প্রকাশ হচ্ছে প্রতিদিন। আমরা অনেকেই এই বিষয়গুলোকে দেখেও না দেখার ভান করছি। কাজেই সময় বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেওয়ার একটি সমন্বিত উদ্যোগ যত দ্রুত নেওয়া যাবে ততই মঙ্গল হবে আশা করি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার; সম্পাদক, আনন্দ আলো।