ড. একরামূল ইসলাম ||
ভারতে করোনা রোগীদের শরীরে ঘটছে একপ্রকার ছত্রাকের সংক্রমণ। তার নাম ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’। করোনার দোসর হয়েছে এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগকে ‘মিউকোরমাইকোসিস’ বলা হয়। এটি এক ধরনের মারাত্মক বিরল ছত্রাক সংক্রমণ, যা মিউকর্মাইসেট নামে এক ধরনের ছত্রাকের কারণে ঘটে। তবে এটি সংক্রামক নয় এবং এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায় না। কিন্তু এই ছত্রাক সর্বব্যাপী অর্থাৎ আমাদের চারপাশের আর্দ্র বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে যেকোনো জায়গায়, যেমন—কাদামাটি, গাছের পাতা, কম্পোস্ট সার, পশু গোবর এবং পচে যাওয়া জিনিসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এই ফাঙ্গাস। বাড়ির এসি বা কুলারেও থাকতে পারে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। এসব উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমিত করতে পারে যে কাউকে। তবে এই ছত্রাক বেশির ভাগ মানুষের জন্য তিকারক নয়। সাধারণত মানুষ নিজের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধমতা দিয়ে এর মোকাবেলা করতে পারে সহজেই; কিন্তু করোনা সংক্রমণের চিকিৎসায় রোগীকে এমন কিছু ওষুধ দেওয়া হয়, যাতে তার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধমতা কমে গিয়ে এই ফাঙ্গাল সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। তবে শুধু যে করোনা রোগীদের মধ্যেই ছড়ায় এমন নয়। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধমতা কম, আগে কোনো গুরুতর রোগের ইতিহাস আছে বা যারা ডায়াবেটিস আক্রান্ত, অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট করা ব্যক্তি আবার কেউ যদি স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে, তাদের েেত্র এই ছত্রাক যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ এবং সংক্রমণের মাত্রাও তাদের েেত্র গুরুতর হতে পারে। করোনা অতিমারি ছড়ানোর আগে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ দেখা যেত প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে একজনের শরীরে এবং মৃত্যুর হারও যথেষ্ট বেশি। কভিড রোগীদের কিংবা কভিড থেকে সেরে ওঠা মানুষের েেত্রই এই সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে ভারতজুড়ে। এমন পরিস্থিতিতে এই অসুখও মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে। চিকিৎসকরা ভারতের করোনা রোগীদের এই ফাঙ্গাস সংক্রমণের অনেক কারণ চিহ্নিত করেছেন
১. গুরুতর অসুস্থ কভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য জীবন রাকারী হাই ডোজের স্টেরয়েড প্রয়োগের কারণে অনেক সময় ডায়াবেটিস এবং নন-ডায়াবেটিস কভিড-১৯ উভয় রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা এবং এসিডযুক্ত রক্ত এই ছত্রাকের বংশবিস্তারের জন্য একটি উর্বর পরিবেশ তৈরি করে।
২. অনেক রোগী কালো ছত্রাক নির্ণয় না করা পর্যন্ত তাদের যে ডায়াবেটিস রয়েছে তা তারা জানত না।
৩. যেসব রোগীকে দীর্ঘদিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বা দীর্ঘদিন নলের মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে হয়েছে, তাদের শরীরে এজাতীয় সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ অনেক েেত্র এই অসুখ ছড়াচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের হিউমিডিফায়ার থেকেই।
৩. গ্রীষ্মম-লীয় জলবায়ু, যা ছত্রাকের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত।
৪. কোন পরিবেশে রোগী রয়েছে তার ওপর নির্ভর করছে। কারণ পরিবেশে, মাটিতে এটি আগে থেকেই ছিল।
মিউকোরমাইকোসিস নামক মারাত্মক এই ছত্রাক সংক্রমণের ফলে রোগীরা কান, চোখ, চোয়ালের সমস্যায় ভুগছেন। শরীরের কোনো ত, কাটা জায়গা, পুড়ে যাওয়া তস্থান দিয়ে শরীরে ঢোকে এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। এ ছাড়া বাতাসে ভাসমান ফাঙ্গাসের স্পোরগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমেও সাইনাস ও ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে। সাইনাস, মস্তিষ্ক আর ফুসফুসে ছাড়া খাদ্যনালি, ত্বক এবং অন্যান্য অঙ্গেও এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। এই রোগের লণগুলোর মধ্যে রয়েছে—জ্বর, সর্দি, মাথা ব্যথা, কাশি, রক্তাক্ত বমি, চোখ বা নাকের চারপাশে ব্যথা এবং লালভাব, নাকের ওপরে কালো ছোপ, দেখতে অসুবিধা হওয়া। নাকের ভেতরের অংশ কালচে রঙের হয়ে যায়। মুখ, গালে ব্যথা। সংক্রমণ বেশি ছড়ালে বুকে ব্যথা এবং শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে। শেষে হচ্ছে মর্মান্তিক মৃত্যু!
মিউকোরমাইকোসিসের সংক্রমণ এড়াতে অনেক ধূলিকণা, যেমন—নির্মাণ বা খননকাজের জায়গা যেখান থেকে ধুলাবালি ছড়িয়ে পড়ছে এমন জায়গা এড়িয়ে চলা। জুতার সঙ্গে মোজা ব্যবহার করুন। খালি পায়ে না ঘোরা। ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের স্পর্শে না যাওয়া। বাড়ির আঙিনা বা বাগানের কাজে অথবা মাটি খননের সময় জুতা, লম্বা প্যান্ট, লম্বা হাতা শার্ট এবং গ্লাভস পরিধান করা। ত্বকের সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস করতে পচা মাটি বা ধূলিকণায় সংস্পর্শে গেলে সাবান ও পানির সাহায্যে ত্বক পরিষ্কার করা। ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। ডায়াবেটিস ছাড়াও যেসব কভিড আক্রান্তের ক্যান্সার, কিডনি রোগ কিংবা লিভার সমস্যা রয়েছে, তাঁদের সাবধান থাকতে হবে। শুধু করোনা চিকিৎসা চলার সময় নয়, সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও। কারণ করোনা থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পরও বহু সময়ে নতুন করে দেখা দিচ্ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ। এটি কভিডের মতো সংক্রামক নয়, তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়