তুষার আবদুল্লাহ ||
আমার
কাছে একটি আর্তচিৎকার ভেসে এসেছিল- ‘শয়তান লোকটা সব ভেঙেচুড়ে বের হয়ে
গেছে। মাকে, আমাকে বাঁচান ।’ এক শিশুর টেলিফোনে সেদিন ঘুম ভেঙেছিল। শিশু
যাকে শয়তান বলে ডেকেছিল, সে ওই শিশুর বাবা। প্রকৌশলী ওই বাবা স্থানীয়
মাদকাসক্তদের সঙ্গে বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েছিল।
অনিয়মিত হয়ে পড়ে চাকরিতে।
পরিবারে শুরু হয় অস্থিরতা। শিশুটি তার বাবার কাছে ভয়ে যেত না। মায়ের ওপর
অত্যাচার শুরু করলে ফোন করে বা চিৎকার করে লোক জড়ো করতো। ওর বাবার কাছে
থাকা ভিজিটিং কার্ড দেখেই ফোন করেছিল আমাকে। দীর্ঘদিন পরিবারটির দিকে নজর
রেখেছি আমি। কতো যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে মা ও শিশুকে। অবশেষে বড়
এক বিপর্যয় কাটিয়ে শিশুটির বাবা স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রক্রিয়ায় আছেন।
খুব কাছের অনেক পরিবারকে জানি, যারা তাদের সন্তানের মাদকাসক্তির কথা জানেন।
বিষয়টি
গোপন করতে গিয়ে সন্তানের চিকিৎসা করান না। যাদের সঙ্গে মেলামেশা করে
সন্তান আসক্ত হলো, তাদের কাছ থেকে সরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেন না। এমনকি
বিয়ের সময়ও সন্তানের মাদকাসক্তের তথ্য লুকিয়ে রাখেন। ফলে সংসার বিষময় হয়ে
ওঠে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের জীবনেরই অপচয় হয় এবং অপরাধমূলক নানা ঘটনা ঘটতে
দেখি আমরা। আজকাল ছেলেদের মতো মেয়েরাও সমান ভাবে মাদকে আসক্ত হচ্ছে।
স্কুলপড়ুয়া থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, গৃহবধূ মাদক আসক্তির বাইরে নেই কেউ।
বাজারে সুলভ প্রায় সব মাদকের সঙ্গেই এদের পরিচয় আছে। মাদক কেনাবেচার কৌশলও
পাল্টে যাচ্ছে। বাড়িতে তো বটেই, অফিস- বিদ্যায়তনেও মাদক গ্রহণ করা থেকে
বিরত থাকছে না আসক্তরা।
এই তো দিন তিনেক আগে একটি অ্যাপার্টমেন্ট
কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকতেই অস্বাভাবিক গন্ধ নাকে এসে টোকা দেয়। গন্ধটা
মাদকের। এমন ফ্যাট বাড়িতে মাদকের গন্ধ, অবাক হই। হঠাৎ এক ফ্যাটের বারান্দা
থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলী বেরিয়ে আসতে দেখলাম। দেখলাম অন্ধকারে বারান্দায়
দাঁড়িয়ে দুই তরুণ তরুণী গাঁজা সেবন করে চলছে।
দ্রুত খেয়ে তারা ঘরের ভেতর
চলে গেল। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ওই বাড়ির ছেলেটির কাছে তার সহপাঠিনী
এসেছিল। তারা যখন গাঁজা সেবন করছিল, তখন ভেতর বাড়িতে পরিবারের অন্য সদস্যরা
ছিলেন। ভরা বাড়ি, খালি বাড়িতে তরুণ তরুণীদের মাদক আড্ডা বা পার্টি নতুন
নয়। কৌতূহল মেটাতে এমন পার্টির মাধ্যমে অভিষেক হওয়ার পর অনেকেই আর মাদক
ছাড়তে পারেনি। আমরা জানতে পারছি মাদক ব্যবসায়ীরা কীভাবে তরুণদের মাদকের
বাহক বানাচ্ছে। বিদ্যায়তনকে মাদকের হাট হিসেবে ব্যবহার করছে। অনলাইন
গ্রুপের মাধ্যমেও চলছে মাদকের কেনাকাটা। মাদক বহন করতে রাজি না হলে, ওই নীল
চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে জীবন দিতে হয়, মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে। আমরা
অনেক তরুণের এই বিপন্নতার কথা জানি। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক
ছাত্রকে মাদকের শিকার হতে দেখলাম।
মাদকমুক্ত বাংলাদেশ- মাদকের বিরুদ্ধে
জিহাদে নামার মতো কতো আয়োজনই দেখলাম আমরা। বাস্তবতা হলো কিছু বাহক আটক,
বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলো। মাদকের মূল নেটওয়ার্ক সচল থাকলো। মূল ব্যবসায়ী
কাউকেই ছোঁয়া গেল না। মাদককেন্দ্রিক আরও অনেক অভিযানই দেশে এলো গেল,
কিন্তু মাদক বাজারে ভাটা এলো না। জোয়ারই বয়ে যাচ্ছে। দেশ মাদকমুক্ত হবে কোন
সুদূর দিনে, জানি না। কিন্তু মাদক থেকে নিজ সন্তান, ভাই-বোনকে রা করা কঠিন
কাজ নয়। শুধু দেখতে হবে পরিবার থেকে কেউ যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে।
সন্তান
কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, কোথায় সময় কাটাচ্ছে সেদিকে নজর রাখা। নিজ ঘরেই
সে কি করছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যা করতে হবে, তাহলো পরিবারে কাউকে যদি
মনে হয় কোন কারণে অবসাদগ্রস্ত, তার সঙ্গে কথা বলা, সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা
করা, প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছেও যাওয়া যেতে পারে। কোনোভাবেই কোন বেপরোয়া
জীবনকে মেনে নেওয়া যাবে না। পরিবারের কাছে সব সদস্যকেই জবাবদিহিতা বা
আনুগত্য থাকতে হবে। তবেই পরিবার মাদকমুক্ত রাখা নিশ্চিত হবে অনেকটাই। দেশ
মাদকমুক্ত করার আন্দোলন শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। তবেই শুরু হবে সাফল্যের
পথে হাঁটা।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।