বশিরুল
ইসলাম:
ফেলনা অচল জিনিস সংগ্রহ করে জীবিকা সচল রেখেছে কুমিল্লার ১২ হাজার
মানুষ। গ্রাম ও শহরের চারপাশে, ময়লার স্তুপে, রাস্তার পাশে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে
থাকা প্লাস্টিক, কাচের বোতল, নারিকেলের মালা, পশুপাখির হাড়, কার্টুন,
কাগজ, লোহার খন্ডাংশসহ নানা ফেলনা জিনিস খোজে তা ক্রয়-বিক্রয় করেই চলে
তাদের জীবন ও জীবিকা। এমন ১২হাজার ২শ জন এই কাজে জড়িত। বাড়ি বাড়ি গিয়ে
ফেলনা ও অচল জিনিস সংগ্রহ করার হকারই আছেন ১০হাজার। আর তাদের কাছ থেকে এসব
পণ্য কিনে রাখেন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২ হাজারের মত। আবার এসব ব্যবসায়ীদের
নিকট থেকে বিভিন্ন কারখানায় সরবরাহ করে এরকম শ্রমিক আছে ২শ’। ফেলনা জিনিস
বা ভাঙ্গারী মালামাল পুনরায় কারখানায় গিয়ে নতুন হয়ে আবার একই জিনিস সাধারণ
মানুষের হাতে আসে। ধাতব বর্জ্য সংগ্রহ এবং রিসাইকেলিং করে আবার কাজে
লাগানোয় প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচর্যায় এসব শ্রমিকদের যে অবদান, সে অনুযায়ী
তাদের জীবনযাত্রার মান সব সময়ই নি¤œমুখী। অথচ এসব পণ্য বিদেশেও রপ্তান হয়ে
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয় বলে জানা গেছে।
দেখা গেছে, বস্তায়, বাঁশের
ঝুড়ি কিংবা ভ্যানে করে শহর বা গ্রামের সাধারণ মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে
সংগ্রহ করা হয় অপ্রয়োজনীয় ফেলে রাখা ব্যবহারে অচল কাগজ-প্লাস্টিক-লোহা বা
অন্যান্য ধাতব জিনিস পত্র। কেউ কেউ পেয়াজ রসুন, হলুদ মরিচ বা আলুর বিনিময়ে
এসব জিনিস সংগ্রহ করেন ঘরবাড়ি থেকে। ততে ইদানিং চল এসেছে কেজি দরে এসব
জিনিস কেনাকাটার। প্রচলতি ভাষায় এসব ভাংগারী ব্যবসায়ীদের অনেকেই আবার ময়লার
ভাগাড়, ডাস্টবিন কিংবা রাস্তার পাশ থেকে কুড়িয়ে মজুদ করেন এসব পণ্য। এসব
মানুষের প্রধান আয়ের উৎসই এই ভাংগারী বেচা-কেনা। ভাঙ্গা শব্দ থেকেই এসেছে
এই ভাংগারী, যারা ভাঙ্গা পণ্য সংগ্রহ করে কেনা বেচা করেন তাদেরকেই চেনা হয়
ভাংগারী ব্যবসায়ী হিসেবে।
এমনই কয়েকজন ভাংগারী ব্যবসায়ীর সাথে কথা হয় কুমিল্লার কাগজের এই প্রতিবেদকের।
ফেলনা
জিনিস বিক্রেতা কাশেম মিয়া জানান, দীর্ঘ ৪৫ বছর যাবত ফেলনা জিনিস তিনি
নিজে সংগ্রহ করেন এবং তার দোকান আছে। দুই ছেলে এক মেয়ে স্ত্রী নিয়ে তার
সংসার। মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন ছোট ছেলে লেখাপড়া করে এবং বড় ছেলে ইউনিয়ন
যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ ব্যবসা করে কোনরকম তাদের দিন কেটে
যাচ্ছে। পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লা জেলার হোমনা থানায়। কুমিল্লা টিক্কারচর
এলাকায় দীর্ঘদিন এই ব্যবসা করে আসছেন।
হোমনা থানার কাশিপুর গ্রামের
তোফাজ্জল হোসেন জানান, প্রতিদিন সকালে বের হন ফেলনা জিনিসপত্র ও ভাঙ্গারী
মালামাল সংগ্রহ করার জন্য। দুপুরে বাসায় ফিরেন। গোসল করে খাওয়া দাওয়া শেষে
একটু বিশ্রাম নেন। বিকালে সেই জিনিসপত্রগুলো বেছে বেছে আলাদা করেন। বিভিন্ন
মালামাল ভিন্নরকম রেট তাই এগুলোকে আলাদা করতে হয়।
টিক্কারচর এলাকায়
বসবাস করেন জমিলা খাতুন। ছেলে মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটান। এসব বলতে
গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির সাহায্য সহযোগীতায়
চলেন। মাসে বাসা ভাড়া দিতে হয় পনেরোশ টাকা। কিন্তু সরকারি কোন সহযোগীতা
তিনি পাননা। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়, মুন হাসপাতাল, পুলিশ লাইন,
চকবাজার, রাজগঞ্জ, শাসনগাছাসহ আশেপাশের এলাকাগুলোতে যেসব জিনিসপত্র পান তা
বিক্রি করে কোনরকম দিন কাটছে।
ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী রফিক মিয়া জানান, তারা
হকারদের কাছ থেকে অল্প অল্প জিনিসপত্র ক্রয় করে জমিয়ে বিভিন্ন বস্তায় রেখে
একদিন সকল মালামাল বিক্রি করে দেন। এসব মালামাল ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ দেশের
বিভিন্ন পাইকারী ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। লোহা ও প্লাস্টিকের মালামাল
যাছে যা কুমিল্লায় কারখানার মালিকদের নিকট বিক্রি হয়। কিছু জিনিসপত্র আছে
যা বিদেশেও রপ্তানি হয়। মালামাল বিক্রির টাকায় চলে একজন ভাঙারি বিক্রেতার
সংসার।
কুমিল্লার পুরনো লৌহ ভাঙ্গারী মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম
জানান, কুমিল্লা জেলায় প্রায় ১২হাজার ২শ শ্রমিক আছে যারা এই পেশার সাথে
জড়িত। এদের মধ্যে কেউ হকার, কেউ ব্যবসায়ী আবার কেউ সাপ্লাইয়ার। তিনি আরো
জানান, শুধুমাত্র কুমিল্লা শহরেই রয়েছে প্রায় ১হাজারের কাছাকাছি যাদের আয়ের
উৎস ফেলনা ভাঙ্গারী জিনিস । এদের মধ্যে ১২০জন ব্যবসায়ী আছে যারা হকারদের
নিকট থেকে এসব জিনিসপত্র ক্রয় করে। একজন হকার চাইলে প্রতিদিন প্রায় ৩শ
থেকে ৪শ টাকা আয় করতে পারেন।
কুমিল্লার পুরনো লৌহ ভাঙ্গারী মালিক
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: দেলোয়ার হোসেন গাজী জানান, এই ব্যবসা তিনি
দীর্ঘদিন করেছেন। বয়স বাড়ার কারণে শুধুমাত্র লৌহ ব্যবসার সাথে জড়িত। এই
পেশার সাথে জড়িত হকাররা ফেলনা বা ভাঙ্গারী জিনিসপত্র সংগ্রহ করে
ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। সেই জিনিসপত্রগুলো ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন
ফ্যাক্টরী বা কারখানার মালিকের নিকট বিক্রি করে। কারখানার মালিক আবার সেই
জিনিসপত্রগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে আবার আমাদের হাতে নতুন জিনিসপত্র পৌছে
দেয়। এভাবে চলছে ফেলনা জিনিসের কর্মযজ্ঞ।