শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
অষ্টম পর্ব
কুমিল্লা সর্বকালেই সাহিত্য-সংস্কৃতি-চর্চার অন্যতম লালনক্ষেত্র এবং পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনতা ও কর্মকা- ঐতিহাসিকভাবে দায়িত্বশীল হয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
নজরুলের জীবনধারা সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা একথা স্বীকার করবেন যে, তাঁর মধ্যে আবেগের তাড়না খুব বেশি পরিমাণেই ছিল। এই আবেগ, উচ্ছ্বাসের ¯্রােতে তিনি আশেপাশের লোকদের সব সময়ে মাতিয়ে রাখতেন, এহেন মানুষের পক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে একাগ্রচিত্তে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উদ্যোগ পর্বে জড়িয়ে পড়ার অনেক আগেই নজরুল প্রথমে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং সেই সূত্রে ক্রমে ক্রমে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও মানসিকভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। এই বিবর্তনের মুখেই তাঁর লেখনী দিয়ে নানা রকমের দেশাত্মবোধক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ও উদ্দীপনামূলক কবিতা, গান ও প্রবন্ধাদি বেরিয়ে এসেছিল। এভাবে তিনি কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
যুদ্ধে যোগদানের ফলে নজরুলের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তারই জের হিসেবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে বদলে গিয়েছিল। চুরুলিয়ার এক অখ্যাত গ্রামের যুবক আন্তর্জাতিকতার দৃষ্টি নিয়ে স্বদেশকে চিনতে শিখেছিলেন। সে সময়কার ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙ্গল’, ‘গণবাণী’, ইত্যাদি কাগজে নজরুলের লেখাগুলোই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তখনকার ব্রিটিশ সরকার ‘ধূমকেতু’কে বেলশেভিক মতবাদ এবং রাজবিদ্বেষ প্রচার করার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে গণ্য করেছিল। এই কারণেই ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা পুলিশ নজরুলের গতিবিধি এবং তাঁর রচনাদি সম্পর্র্কে বিশেষভাবে খোঁজ খবর করে সেই সব রিপোর্ট নিয়ম করে জায়গা মত মনিটর করতো। ল-নের ই-িয়া অফিসে স্যার সিসিল কে ই কর্তৃক ১৯২২ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ১৯২৩ সালের ১০ মে অবধি সংগৃহীত সংবাদের ভিত্তিতে পাঠানো এই রকম একটি প্রতিবেদনে লেখা ছিল-
‘ওরা (অর্থাৎ কমিউনিষ্টরা) সরাসরি প্রচার কাজ শুরু করেছে। তাদের বিশেষ সংবাদপত্র ‘ধূমকেতু’ তিনবার অভিযুক্ত হয়েছে এবং দুই সম্পাদকের শাস্তি হয়েছে।’
আসলে এখানে একজন প্রকাশক জনাব আফজালুল হক ও একজন সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সরকারের ইনটেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চের ১০৯/১৯২৩ নম্বর ফাইলে বলশেভিক মতাদর্শ প্রচার কার্যে লিপ্ত বাংলাদেশের সে সব পত্র পত্রিকা তালিকা দেওয়া আছে। (Newspapers and periodicals in Bengal which advocate Bolshevism)তাতে একেবারে এক নম্বরে উল্লেখ আছে নজরুলের ‘ধূমকেতু’।
1. The Dhumketu : Its editor Nazrul Islam has since been
convicted U/S 124 I. P. C and sentenced to 1 year R. I. Amaresh Kanjilal
who succeded Nazrul as the editor has also been prosecuted (u/S 124
I.P.C The case is pending.)
এবং নির্দেশনামায় লিখিত হয়-
These notes may be placed on the 'Bolshevic' file you have opened.
এই রিপোর্টের নানা স্থানে ব্রিটিশ বিদ্বেষী ভারতীয় মুসলিমদের গোপন সংগঠনগুলির কথা উল্লেখ করে জানানো হয়েছিল যে এদেরই মাধ্যমে ভারতে বলশেভিজিম প্রচার করা হচ্ছিল। উল্লেখ্য নজরুল সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের এই সন্দেহ, আর একটি আই বি ফাইলে (নং ১৯৬/১৯২৫, সিরিয়াল নং ৪৪/১৯২৫) স্পষ্টভাবেই লেখা হয়েছিল। এই ফাইলে একটি রিপোর্টে বাংলা পুলিশের জনৈক ডিপুটি সুপারিনটেনডেন্ট নজরুলের নাম উল্লেখ করে লেখেন-
This Kazi formed a secret Muhammadan organisation in Comilla, I shall not be surprised to hear that Aftab ul Islam of Tiperah now trying to organise a sebadal was a satelite of Nazrul Islam.
পুলিশ সুপারের উপর্যুক্ত মন্তব্যের ঠিক বাঁ দিকের মার্জিনে গোয়েন্দা বিভাগের অপর একজন উর্ধতন কর্মচারী এই নোটের পরিপূরক হিসেবে একটি জবরদস্ত নির্দেশ তাঁর আপন হস্তাক্ষরে লিখে রাখেন-
Vigorous attempts should be made to bring to light Kazi Nazrul Islam's connection with Hundu revolutionaries and the Bolshevik Movement. It is said he has got a revolutionary party under him in Comilla. His wife is a woman (Hindu) of Comilla and it is a probable that he got his gang in that locality.
এইসব ঘটনার ঐতিহাসিক প্রামাণিক ভিত্তি যদিও খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবুও কুমিল্লায় নজরুলের রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল। বিপ্লবী অতীন্দ্রমোহন রায়ের জবানীতে তার কিছুটা সত্যতা মেলে। এতে স্পষ্টই ধারণা করা যায়- নজরুলের কুমিল্লার প্রতি অন্যতম আকর্ষণ রাজনৈতিক। মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন যে, নজরুল বিয়ে করার পর অর্থাৎ ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসের পরে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন।
‘এই সময়েই বাংলাদেশে নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরে সে রাজনীতিক সভা সমিতিতে বক্তৃতা দেওয়া আরম্ভ করেছিল। পুলিশের গুপ্তচরেরা তার পেছনে ঘোরা আরম্ভ করেছিল এই সময় হতেই। তার গতিবিধি কেবল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সভা সমিতিতে আর সীমাবদ্ধ থাকল না।’
এ প্রসঙ্গে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে- নজরুলের রাজনীতিক জীবনের সূতিকাগার কুমিল্লা এবং সমকালীন কুমিল্লার পরিবেশ।
নজরুলের রাজনৈতিক চিন্তা ধারার পটভূমি রচনায় কুমিল্লার সমকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, তবে রাজনীতি তাঁর মননে-চিন্তনে জাগরুক ছিল, রাজনীতির বলয়ে তার বিচরণ এবং অভিভাবকত্ব ছিল, দিক নির্দেশনা ছিল এবং কখনো কখনো প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বিপ্লবী বারীন ঘোষ, সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, এ কে ফজলুল হক, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য ও ঘনিষ্ঠতা লাভ করেও তিনি স্বাতন্ত্রিক রাজনীতি-আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। এই বিশ্বাস মানব কল্যাণে নিবেদিত, সাহিত্য তাঁর প্রচার মাধ্যম, একলা চলার নীতিতে অগ্রসরমান একজন যুগপুরুষ-সমন্বয়ের প্রতিমূর্তি, বিশ্বাসে-কর্মে ও কথায় ব্যক্তিক্রমী, প্রকাশে অকুতোভয়।
‘আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্নিশ।’
নজরুল জীবনের এই যে মানসক্ষেত্র- তা রচিত হয়েছিল এই কুমিল্লার রাজনীতি-চর্চার পটভূমিকায়।
নজরুলকে বলা হয়ে থাকে গানের কবি, প্রেমের কবি, যৌবনের কবি., সাম্যবাদের কবি- পাঁচবার কুমিল্লায় আগমনের ফলে সে সময় যাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তাঁদের প্রভাব এবং সাহচর্যের অবদান কী কম। ওস্তাদ খসরু, শচীনকর্তা, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, সুশীল মজুমদার প্রমুখের সান্নিধ্য, অসাম্প্রদায়িক ইন্দ্রকুমার সেনের পরিবার- যেখানে নজরুলের স্থিতি, পরিচিতি, আশ্রয় এবং শিকড়, বিরজাসুন্দরীদেবীর মাতৃ¯েœহ এতো এক দুর্লভ প্রাপ্তি, কুমিল্লার সমকালীন জনসাধারণের অকুণ্ঠ ভালবাসা সবকিছু মিলিয়ে আমরা গর্ব করেই বলব-নজরুলের সাথে কুমিল্লার এবং কুমিল্লাবাসীর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।
নজরুল জীবনে যেমন কুমিল্লা ও কুমিল্লার আপনজন রক্ত¯্রােতে একাকার হয়েছে, তাঁর চিরকালীন পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠায় সাহিত্য ও সঙ্গীতে কুমিল্লা-স্মৃতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। বিশেষত কবির কবিতা ও সঙ্গীতের জগৎ কুমিল্লা-সংস্পর্শে আলোকিত। কুমিল্লাবাসী শ্রদ্ধাভরে নিরন্তর নজরুলকে স্মরণ করে, আত্মীয় হিসেবে যতটুকু নয়- সৃষ্টির আভিজাত্যে, আত্মিক বিমূঢ়তায়- তার চেয়েও বেশি।
[নবমপর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]