অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল ‘নীল মুকুট’ আসছে। কবে কোথায় কীভাবে এ সিনেমা দেখা যাবে, তা নিয়ে শুরু থেকেই ছিল অনিশ্চয়তা। এই ছবি, উৎসবকেন্দ্রিক ছবি ও বাজার, মহামারিকালে প্রদর্শনের সংকটসহ নানা বিষয়ে কথা বললেন পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন।
অনেক দিন থেকেই আপনার তিনটি ছবির কথা শোনা যাচ্ছে। ‘নীল মুকুট’, ‘অন্যদিন...’ আর ‘শিকলবাহা’। ছবিগুলো দর্শক কবে দেখতে পাবেন?
ছবি বানানোর সিদ্ধান্ত আমার, দেখানোর সিদ্ধান্ত আমার একার হাতে নেই। ২০১৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ‘শুনতে কি পাও’ মুক্তির পর নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারা দেশে ৮৮টি হল কনফার্ম হয়েছিল। সেটা ছিল নির্বাচনের বছর। ডিসেম্বর আসতেই শুরু হলো জ্বালাও-পোড়াও। মুক্তির ঠিক এক সপ্তাহ আগে এমন পরিস্থিতি হলো যে সব শো বাতিল করতে বাধ্য হলাম। তার পরের বছরগুলোয় কান–বার্লিন–লোকার্নোতে একটার পর একটা প্রোগ্রাম আর ৩টি ছবির শুটিং নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। তবে আগেই ঠিক করেছিলাম, কোনো উৎসব ছাড়াই ‘নীল মুকুট’ মুক্তি দেব। ২০২০ সালের ২৭ মার্চ ছবি মুক্তি পাওয়ার কথা, ২৫ মার্চ শুরু হলো লকডাউন। ২০২১ সালের শুরুতে আবার দেখলাম, হল খুলল, একটি–দুটি করে ছবিও মুক্তি পেল। ভাবলাম, তাহলে ঈদুল ফিতরেই ‘নীল মুকুট’ মুক্তি দেব। রোজায় আবার শুরু হলো লকডাউন। ঈদুল আজহা আসতে আসতে এখন দেখি, কোভিড আবার ঘন হয়ে উঠছে। কোভিডের জীবনটাই একটা সিনেমা হয়ে গেল।
উৎসবে না পাঠানোর কারণ কী?
আন্তর্জাতিক উৎসব সার্কেলে ‘শুনতে কি পাও’–এর ব্যাপক সাফল্যের পর অনেকেই বলেছিলেন, আমরা নাকি কেবল উৎসবের জন্যই ছবি বানাই। তার ওপর গত ১০ বছরে উৎসব নিয়ে বাড়াবাড়িটাও ছিল চোখে লাগার মতো। এসব ভালো লাগছিল না। আমরা যাঁরা একাত্তর–উত্তর প্রজন্ম, ২০১১ সালের পর থেকে তারেক মাসুদ-উত্তর সময়ে ছবি বানাতে এসেছি, আমাদের মধ্যে উৎসব নিয়ে একটা বিচিত্র অস্থিরতা শুরু হয়। ছবি কী বানালাম, তার চেয়ে বেশি আমরা উৎসব নিয়ে কথা বলতে শুরু করি। উৎসবের বাজারে ছবি পাঠিয়েই উদ্যাপন শুরু করে দিই, ছোটখাটো উৎসবে ছবি গেলেই বড় বড় প্রচারণা শুরু করি। তাই অনেকেই, যাঁরা বিষয়টি ঠিক বোঝেন না বা কম জানেন, গোটা বিষয়টা তাঁদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। কয়েক দিন আগে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের কানের অফিশিয়াল সিলেকশনের মতো বিরাট অর্জনকেও কেউ কেউ পোস্ট কলোনিয়াল প্রকল্পের অংশ বলে ভেবেছেন। উৎসব নিয়ে এই কোন্দল মূলত আমাদের হীনম্মন্যতা, এটা একটা উত্তর-ঔপনিবেশিক চাপ। এই সময়ের একজন নির্মাতা হিসেবে বিষয়টি আমার ভালো লাগেনি। তাই একটা ছবি কোনো উৎসব ছাড়া মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অনেকদিন আগেই।
কামার আহমাদ সাইমনের প্রথম ছবি শুনতে কি পাও!
কামার আহমাদ সাইমনের প্রথম ছবি শুনতে কি পাও!
উৎসব কি তবে পোস্ট কলোনিয়াল প্রকল্প নয়?
আর্ট-কালচার-সিনেমা তো আর পৃথিবীর বাইরের কিছু না। তাবৎ দুনিয়াই যেখানে গ্লোবালাইজড, সেখানে শুধু সিনেমাকে দোষ দেওয়া অন্যায়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নোবেল যেমন এই প্রকল্পের অংশ, তেমনি আমাদের সাকিব আল হাসানের বিশ্বসেরা স্বীকৃতি, সত্যজিতের অস্কার, মঙ্গল শোভাযাত্রার ইউনেসকো সনদ, এমনকি ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন—এ সবই বিশ্বায়নের ফসল, পোস্ট কলোনিয়াল প্রকল্প। ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে একাত্তর–উত্তর প্রজন্মের কাছে প্রশ্নটা বরং হতে পারত, সেই বিশ্বায়নকে আমরা কীভাবে ডিল করব? আমরা ছবিমেলার আশপাশেই ঘুরঘুর করব, নাকি সত্যিই নিজেদের কাজে মন দেব। কী বানাচ্ছি, কেন বানাচ্ছি, কার ভাষায় বানাচ্ছি, সেটা নিয়ে ভাবব? ২০৩১ সালে যে ছবিটা অস্কারে পাঠাব, সেটার ভাষা কী হবে, বাছাইপ্রক্রিয়া কী হবে, সেসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার এখনই সময়। প্রতিটি প্রজন্ম একটা দশককে ডিফাইন করে। ২০২১ থেকে ২০৩১—এই দশক নির্ভর করবে আমাদের ওপর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পরের এই দশক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সেই প্রক্রিয়া কীভাবে শুরু হবে?
একাত্তর–উত্তর প্রজন্মের হাত ধরেই শুরু হবে এই প্রক্রিয়া। আজ যাঁরা ছবি বানাচ্ছেন বা বানানোর পরিকল্পনা করছেন, তাঁদের মগজ ডি-কলোনাইজড হতে হবে। আন্তর্জাতিক হওয়ার আগে স্বদেশি হতে হবে। ছবি নিয়ে আন্তর্জাতিক দর্শকের কথা ভাবার আগে, নিজের দর্শককে বুঝতে হবে। উৎসবে যেতে হবে, ছবি দেখতে হবে, ছবি দেখাতে হবে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি বুঝতে হবে নিজের দেশের দর্শককে। চোখ যদি থাকে আকাশে, পা রাখতে হবে মাটিতে।
তাহলে ‘নীল মুকুট’ আমাদের দর্শক কবে দেখবেন?
কোভিডের যে অবস্থা, এর মধ্যে কীভাবে কোথায় ছবি মুক্তি দেব, জানি না। ওটিটি হয়তো একটা অপশন, কিন্তু বড় পর্দার বিকল্প নয়। প্রতিবার ছবি মুক্তির আগে এই যন্ত্রণা শুরু হয়, এই ব্যথা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।
কোভিড তথাকথিত বাণিজ্যিক ধারার ছবির খুচরা বাজারকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আপনারা বিকল্পধারার নির্মাতারা একে কি সুযোগ মনে করেন?
প্রচলিত বাণিজ্যিক ধারার ছবির দর্শক বেহাত হয়ে গেছে। কষ্ট করে হলে গিয়ে কেউ ছবি দেখবেন, সেই অবস্থা আর নেই। তাঁদের কাছে সব ধরনের ছবির দুনিয়া উন্মুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদেরও তাঁদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ বেড়েছে।
কোভিডে কিন্তু সবকিছু চলছে। তা ছাড়া সিনেমাকে টিকে থাকতে হলে মহামারির এই সংকটকালেই এগিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে কী ভেবেছেন?
ওটিটি, প্রযোজক, ডিসট্রিবিউটর, হলমালিক—সবাইকে নিয়েই আমাদের এ সংকট মোকাবিলা করতে হবে। নয়তো দর্শক বাণিজ্যিক বা আর্ট—কোনো সিনেমাতেই ফিরবেন না। বাংলাদেশের সিনেমা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে।