ইয়াসমীন রীমা ।।
পৃথিবীর পথ ধরে চলছি। চলতে চলতে কতজনকে আপন করেছি, কত আপনজন হারিয়েছি। বুঝতে পারি না পাওয়ার নাম জীবন না হারানো। এ যোগ-বিয়োগের হিসাব সহজে মেলে না। চলতে চলতে কিছু মানুষ হারায়, কিছু মানুষ থাকে। আসলে জীবনে কি থাকে? শেষ পর্যন্ত কিছুই কি থাকে! যেই অন্ধকার থেকে এই বিশ্বে আসা সেখানেই প্রস্থান।
সম্পাদক শামসুনন্নাহার রাব্বী তাঁর জীবনের বিরতীহীন যাত্রার সমাপ্তি করেছেন। পেশার জগতে তিনি কতটা উৎকষ ছুঁয়েছিলেন আমি জানবার চেষ্টা করিনি, আমি তার ব্যবহারের ¯িœগ্ধতা ও অন্তরের সুবাস খুঁজে পেয়েই আহ্লাদিত হয়েছি। শামসুন্নাহার রাব্বী আমার বিশেষ ভালোবাসা শ্রদ্ধাভাজনের একজন। তাঁকে ভালোবাসি মানুষ হিসাবে তঁর নানা মানবিক গুনাবলির আর অবশ্যই অসাম্য ও সামাজিক বঞ্চনাকে গভীরভাবে চিন্তনীয় কিছু দূরাদৃষ্টি, কিছু আত্মসমালোচনা আর অন্য এক মানবিক বোধের জন্য। জীবনবোধ ছিলো তাঁর কথায়,মননে। শুরু থেকে তাঁর বিভিন্ন কাজের মধ্যে একটি পরিপাঠ নান্দনিকাতার ছাপ ছিলো তা কারো দৃষ্টি এড়াতো না। তিনি ছিলেন এক পরিচ্ছন্ন রুচির সৃজনশীল মানুষ।
১৯৭২সালে শামসুন্নাহার রাব্বীর লেখা প্রতিবেদনে ওঠে এসে ছিলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনের চিত্র। তা কিনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। ১৯৫৭সালে ২০অক্টোবর সাপ্তাহিক আমোদ প্রতিষ্ঠাতা মো: ফজলে রাব্বীর সহধর্মিনী হন তিনি। পত্রিকা ভাঁজ করা, পোষ্টাল টিকেট লাগানো, প্রিন্টেট ঠিকানা সংযোগ করা, বানান প্রুফ দেখা ইত্যাদি কাজ করতেন তিনি নিজ হাতে। তাঁর জীবনের লেখা প্রথমটি প্রতিবেদনটি ছাপা হয় সম্পাদক ফজলে রাব্বী সম্পাদনায় হাত গলিয়ে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় যার শিরোনাম ছিলো “সিনেমা হলে চা চক্র”। ১৯৬৫-৬৭সাল পর্যন্ত মাসিক “ময়নামতি” নামে সাহিত্যপত্র সম্পাদনা ও ’৬০বছরের বেশি সময় ধরে সব মিলিয়ে শামসুননাহার রাব্বী নিরবিচ্ছিন্নভাে সক্রিয় ছিলেন তাঁর সৃষ্টিশীল বিচিত্র সংরূপের মাধ্যমে সমাজ মানসের সংবাদপত্রের বস্তনিষ্ঠতার ও নাগরিক জীবনে মনস্তÍত্বের স্বতন্ত্র্য উপলব্ধিতে অন্যদিকে ১৯৭৯ সালে হজ পালন করে দেশে ফিরে ঘটমান জীবনবোধেকে তাঁর নিজস্ব জীবননোপলদ্ধি ও কল্পনা প্রতিভার সম্বন্বয়ে আমাদের জন্য স্মৃতিমূলক গ্রন্থ “মহামিলনের মহামেলায়”সহ গল্পগন্থ ব্যবধান ভ্রমণ কাহিনী “প্রতীচ্য” ও তাঁর পাঁচ দশকের বিভিন্ন লেখা নিয়ে গ্রন্থ “ভালোবাসার পাঁচ দশক”।
ব্যক্তি ও সংবাদকর্মী-সাহিত্যসেবী শামসুনন্নাহার রাব্বীর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ সর্ম্পক ছিলো প্রায় ২০বছরের অধিককালের। তাঁর মৃত্যুতে আমি একজন সমাজউন্নয়নকামী পূর্বসূরি, ঘনিষ্ঠ অভিভাবক, এবং মানস আত্মীয়কে হারালাম। মৃত্যুকে আমি ধ¦ংস হিসাবে গণ্য করি। গভীর শূণ্যতা সে মানুষটি হারিয়ে যায়। কোন অস্তিত্বই আর কোনকালে থাকে না। বিশে^ যা রেখে যায় সেটাই তার সম্পদ। নিজের সৃষ্টি থেকে, বিচ্ছিন্নতার চাইতে বেদনার আর কি থাকতে পারে? যে বিচ্ছিন্নতা তাঁর কর্মময় জীবনের সমাপ্তি টানে সেখানেই তাঁর জীবনের যতি। কবি নির্মলেন্দু গুণের কথায় “মৃতেরা থাকে না গৃহে বেশিক্ষণ,গৃহহীন আপনার গৃহে/ রেখে যায় তাঁর স্পর্শ, স্মৃতি প্রাণ।”