পিয়াস মজিদ ।।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কুমিল্লার মোগলটুলি এলাকায় বসবাস করতে গিয়ে 'রাব্বী' পরিবারকে দেখেছি ছোট্ট আমি। যে বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম সে বাড়ি এবং পাশ্ববর্তী বাড়ির সদস্যরা ছিলেন 'রাব্বী' পরিবারের আত্মীয়। শামসুননাহার রাব্বী এবং তাঁর মেয়েদের কেউ কেউ সেখানে বেড়াতে আসতেন মাঝেমধ্যে। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য চকলেট, টফি নিয়ে আসতেন। এভাবে শামসুননাহার রাব্বী হয়ে উঠেছিলেন আমাদের প্রিয় খালাম্মা। তখন সংবাদপত্র সম্পর্কে কিছু জানতাম না। একটু বড় হয়ে পাশের চৌধুরীপাড়ায় খেলতে গেলে দেখতাম 'আমোদ' পত্রিকার অফিস। কৌতুক বোধ করতাম বাড়ির সামনের দেয়ালে সাঁটা পত্রিকা দেখে। পরে জানলাম এ বাড়িতেই থাকেন শামসুননাহার রাব্বী খালাম্মারা।
কিছুকাল পর আমরা মোগলটুলি ছাড়লেও পত্রপত্রিকা নিয়ে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে লেখালেখির সূত্রে। তখন 'আমোদ' অফিসের সামনে ঘুরঘুর করতাম বন্ধু তুহিন আর আমি। ইশ, যদি চাক্ষুষ করতে পারতাম কী করে পত্রিকা ছাপা হয়! আমাদের এভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে অফিসে কর্মরত বাকিন রাব্বী ভাই ডাকলেন একদিন। চা খাওয়ালেন, খালাম্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি বললাম ছোটবেলায় তাঁকে দেখার কথা, 'সবই ধূসর স্মৃতি' বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
চলে এলাম সেদিন, দু'একটা লেখা ছাপা হল আমার 'আমোদ'-এ। তখন অনেক কাগজে লেখা বেরুলেও 'আমোদ'- এ বেরুলে আনন্দ- আমোদ বোধ করতাম কারণ সংবাদপত্রটির শীর্ষে ছাপা 'দেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক' কথাটি পুরাতাত্ত্বিক ঘ্রাণ সঞ্চার করত হৃদয়ে।
'আমোদ' পত্রিকার স্বপ্নমানুষ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী। শামসুননাহার রাব্বী সৃজন-মানবী। গোটা একটি পরিবারের সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার ঘটনা 'ইত্তেফাক' এবং মানিক মিয়ার পরিবারের কথা মনে করিয়ে দেয়। 'আমোদ' তার নিয়মিত প্রকাশনা-যাত্রায় দেশের গ-ি পেরিয়ে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এর নেপথ্যে শামসুননাহার রাব্বীর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর কথা মনে আসলে আমার 'বেগম'-এর নূরজাহান বেগম আপার কথা স্মরণে আসতো। পুরান ঢাকার শরৎ গুপ্ত সড়কের বাড়িতে বাবার স্মৃতিবাহী পত্রিকাটি পুরনো জৌলুসে আমৃত্যু প্রকাশ করে গেছেন তিনি। শামসুননাহার রাব্বী এবং তাঁর সন্তানেরাও ফজলে রাব্বীর স্মৃতিকে ম্লান হতে দেননি; পত্রিকার সচল অভিযাত্রাই এর প্রমাণক। দিন পাল্টেছে কিন্তু 'আমোদ'-এর অঙ্গীকার পাল্টায়নি। 'আমোদ' প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠবাহী হয়ে টিকে আছে আজও; দেশের অনেক নামকরা আঞ্চলিক কাগজ যখন মার্কিন নির্বাচনের সংবাদ নিয়ে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশের মতো অপচয় করে চলে 'আমোদ' তখন গোমতী নদীর ভাঙন বা কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার দরিদ্র চাষী ও মজুরের দুঃখকথা পাঠকের কাছে তুলে ধরে। এখানেই স্বতন্ত্র ও অনন্য 'আমোদ'।
শামসুননাহার রাব্বীর প্রসঙ্গে প্রায়ই কথা হতো কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলতেন শামসুননাহারের প্রজ্ঞা ও পরিশ্রমের কথা। যেমন কাল রাতে (২৫ জুন) আমার কাছ থেকে মৃত্যুসংবাদটি শুনে গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বললেন তাঁর নানা গুণের কথা। এমন গুণগ্রাহী দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে অনেক।
সংবাদকর্মীদের কাছে তিনি একজন গুণী শিক্ষক, পরিবারের কাছে আদর্শজন আর আমার কাছে ছোটবেলার চকলেট-টফি উপহার দেয়া প্রিয় খালাম্মা।