ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
করোনাকালীন প্লাস্টিকদূষণ রোধে করণীয়
Published : Saturday, 10 July, 2021 at 12:00 AM
করোনাকালীন প্লাস্টিকদূষণ রোধে করণীয়বিধান চন্দ্র দাস  ||
করোনা (কভিড-১৯) শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য (পিপিই ও অন্যান্য) হাসপাতাল, কিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে। প্রভাবশালী জার্নাল ‘ল্যানসেট’ ঢাকার সংবাদপত্র উদ্ধৃত করে বলছে, কভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশে চিকিৎসা বর্জ্য অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে কভিড-১৯ কেন্দ্রিক চিকিৎসা বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ব্যাপারেও আশঙ্কা করা হয়েছে। কভিড-১৯ থেকে সুরার জন্য সিনথেটিক অথবা সেমিসিনথেটিক ‘ফেস মাস্ক’ দেশের রাস্তাঘাটে যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে এর বেশির ভাগ শেষ পর্যন্ত নর্দমা, পুকুর, ডোবা, খাল, বিল ও নদীতে গিয়ে পড়ছে। এর ফলে এসব জলাশয় ও জলজ জীবের তি হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিকদূষণের ওপর সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দেশি-বিদেশি গবেষক মিলে এই প্রকাশনাগুলো করেছেন। যেসব জার্নালে এগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে এলসিভিয়ার, টেইলর অ্যান্ড ফ্যান্সিস, স্প্রিংগারের মতো বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থগুলো আছে। এই প্রবন্ধগুলোতে বাংলাদেশে প্লাস্টিকদূষণের অস্বস্তিকর চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২১-এর এপ্রিল পর্যন্ত প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর লেখক বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা। গত বছর জানুয়ারিতে বিবিসি বাংলা বিভাগ, ‘বাংলাদেশে হু হু করে বাড়ছে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার, দূষণের শীর্ষে তরুণ-যুবকরা’ শিরোনামে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দেশের জলে, স্থলে অন্তরীে সব জায়গায় প্লাস্টিক তার দূষণ ছড়াচ্ছে। বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা অচল হয়ে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের কারণেই মিঠা পানি ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র আজ হুমকির মুখে। মাটির বাস্তুতন্ত্রকেও প্লাস্টিক তিগ্রস্ত করছে। আমাদের দেশে অনেক সময় প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো হয়। অবাছাইকৃত এসব বর্জ্য নির্বিচারে পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ ঘটে থাকে। বিশেষ করে চিকিৎসা বর্জ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত নীতিমালা না মেনে পোড়ানো হলে তা থেকে মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক উৎপাদন ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছিল ৬.৬ লাখ টন। আট বছরের ব্যবধানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২.৬ লাখ টন। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ খুব কম হলেও মূলত আমাদের প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কয়েক বছর আগে প্রভাবশালী বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় এক থেকে তিন লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে।
প্লাস্টিকদূষণের পথ ধরে আমাদের অনেকের শরীরে প্রতিদিন যে মাইক্রোপ্লাস্টিকস প্রবেশ করছে, সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। মাইক্রোপ্লাস্টিকের অন্যতম উৎস হচ্ছে আমাদের ব্যবহৃত ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের তৈরি নানা রকম দ্রব্য আমরা যখন ঘরের বাইরে ফেলি, তখন তা সূর্যালোক, তাপমাত্রা, মাটির সঙ্গে ঘর্ষণ, পানির ঢেউ, স্রোত ইত্যাদি কারণে ছোট ছোট কণায় পরিণত হয়। এই কণার দৈর্ঘ্য এক থেকে পাঁচ হাজার মাইক্রোমিলিমিটারের মধ্যে হলে তাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। গবেষণা বলছে, এই মাইক্রোপ্লাসটিকস মাটিতে বা পানিতে কয়েক দশক থেকে কয়েক শ বছর পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। ফলে মানুষ, জীবজগৎ, মাটি, পানি তথা পরিবেশের জন্য ভয়ংকর তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মাইক্রোপ্লাসটিকস। সিনথেটিক প্রসাধনী, পরিষ্কারকদ্রব্য, রং ইত্যাদি থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিকস পরিবেশদূষণ ঘটায়।
প্রভাবশালী জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত (মে ২০২১) এক প্রবন্ধে বলা হচ্ছে, বাতাস, পানি, লবণ, সামুদ্রিক খাবারের মাধ্যমে শিশু ও আমাদের শরীরে প্রতিদিন এক ডজন থেকে এক লাখ প্লাস্টিক কণা প্রবেশ করছে। এক মাইক্রোমিলিমিটারের কম কণাগুলো আমাদের শরীরের কোষের মধ্যে পৌঁছে কোষের স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে বলে প্রবন্ধে এ ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে ঢাকার আমিনবাজার বর্জ্য ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করা মাটির নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিকস পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, এখানে জমা হতে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিকস একসময় শস্যতেসহ স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য জায়গার মাটিকেও তিগ্রস্ত করবে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে শেষ ভাটির সময়ে সংগ্রহ করা প্রতি কিলোগ্রাম ভেজা বালুর নমুনায় ২০০ থেকে প্রায় ৪০০ মাইক্রোপ্লাসটিকস পাওয়া গেছে। এই মাইক্রোপ্লাসটিকসের মধ্যে ৫৩ শতাংশ ছিল আঁশজাতীয় বস্তু। অন্যান্য মাইক্রোপ্লাসটিকসের মধ্যে ছিল ফিলম, ফোমস, দানা ইত্যাদি। এক হিসাবে বলা হয়েছে, বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য মেশার পরিমাণ প্রায় ১৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ কথা ঠিক যে প্লাস্টিক এখন আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বাংলাদেশে এই শিল্পের সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার ছোট-বড় কারখানা ও ১০-১২ লাখ মানুষ প্রত্য কিংবা পরোভাবে জড়িত। গত ১৫ বছরে এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ তিন গুণ (৩৯ থেকে ১২০ মিলিয়ন ডলার) বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ইচ্ছা করলেই আমাদের জীবন থেকে প্লাস্টিককে সম্পূর্ণ বাদ দিতে পারব না। এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়েই প্লাস্টিকদূষণ মোকাবেলা করতে হবে।
প্লাস্টিকদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে যতটা সম্ভব প্লাস্টিককে ‘প্রত্যাখ্যান, কম ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহার’ বিষয়টি মেনে চলা প্রয়োজন। আমাদের দেশে প্লাস্টিকদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে এই বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা। বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক থেকেই বেশি দূষণ ঘটছে। এ ধরনের প্লাস্টিক যত দূর সম্ভব কম ব্যবহার ও এর গ্রহণযোগ্য বিকল্প অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। প্লাস্টিক কারখানাগুলোকে মানসম্মত, বিশেষ করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক তৈরি করতে হবে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক প্রকৃতিতে যেন না মিশতে পারে, তার জন্য উন্নত দেশগুলোর ব্যবস্থা (সংগ্রহ, রিসাইকেল) আমাদের দেশের উপযোগী করে অনুসরণ করা যেতে পারে।
বাদ দেওয়া প্লাস্টিক বিক্রি করে সন্তোষজনক মূল্য পেলে ভোক্তা কখনো তা বাইরে ফেলে দেবেন না। যেমনটি দেন না খবরের কাগজ। বাদ দেওয়া প্লাস্টিক বেচে উপযুক্ত মূল্য পেলে আমাদের দেশের অনেক বেকারেরও কিছু উপার্জন হবে। নদী ও সমুদ্রে মৎস্য আহরণকারীদের মধ্যে ছেঁড়া জাল, দড়ি কিংবা অন্যান্য প্লাস্টিক সরঞ্জাম নদী, সমুদ্র অথবা বালুচরে না ফেলার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রয়োজনে এসব নষ্ট হওয়া প্লাস্টিকদ্রব্য তাঁদের কাছ থেকে ক্রয় করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দেশের সব অঞ্চলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাসহ মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের পরিবেশ ও জীবন সুস্থ রাখার জন্য প্লাস্টিকদূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।
 লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়