নতুন হাসপাতাল নির্মাণ
কিংবা পুরোনো হাসপাতালের সম্প্রসারণ বা আধুনিকায়নে কারও আপত্তি থাকার কথা
নয়। বিশেষত করোনাকালে প্রমাণ হয়েছে- বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে চিকিৎসা
অবকাঠামো ও ব্যবস্থা এখনও কতটা অপ্রতুল। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীতে যেভাবে
শতবর্ষী গাছগাছালি ও নজরকাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করে হাসপাতাল
নির্মাণের তোড়জোড় চলছে, তা কোনোভাবেই সুবিবেচনাপ্রসূত হতে পারে না।
শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ
রেলওয়ে এবং ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি বেসরকারি
কোম্পানি যৌথভাবে এই হাসপাতাল নির্মাণ করতে যাচ্ছে। আমাদের প্রশ্ন,
চট্টগ্রামে কি হাসপাতালের জন্য জায়গার অভাব? আমরা জানি- পাহাড়, নদী ও
সমুদ্রের মিলনস্থলে গড়ে উঠলেও গত কয়েক দশকে নয়নাভিরাম নগরটিতে উন্মুক্ত
স্থান ও সবুজ এলাকা আর আগের মতো নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বুক ভরে
নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগও কমে গেছে। এখনও সামান্য যে কয়টি এলাকা অুণ্ণ রয়েছে,
তার একটি এই 'সিআরবি' বা সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং এলাকা। সেখানেও
কংক্রিটের আগ্রাসনের খবরে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না।
আসাম-বেঙ্গল
রেলওয়ে সদর দপ্তর হিসেবে উনিশ শতকে গড়ে উঠলেও একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ওই ভবন এবং
সংলগ্ন এলাকাকে নিছক 'রেলওয়ের সম্পত্তি' হিসেবে বিবেচনার অবকাশ নেই।
ব্রিটিশ আমলের চুন-সুরকির সিআরবি ভবনকে ঘিরে শতবর্ষী গাছগাছালি, পিচঢালা
আঁকাবাঁকা রাস্তা, ছোট-বড় পাহাড়-টিলা আর নজরকাড়া বাংলোগুলো নাগরিকদের
চিত্তবিনোদনেরও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। প্রাকৃতিক এই পরিবেশকে চট্টগ্রাম
নগরীর 'ফুসফুস' যে আখ্যা দেওয়া হয়, তার মধ্যে অত্যুক্তি থাকতে পারে না।
একটি সরকারি সংস্থা এভাবে নগরীর ফুসফুস ধ্বংস করতে চায়, বিশ্বাস করা কঠিন।
মনে রাখতে হবে, কেবল হাসপাতাল দিয়ে একটি নগরীর স্বাস্থ্য সুরা সম্ভব নয়।
বরং উন্মুক্ত মাঠ, খোলামেলা প্রকৃতি, সবুজ উদ্যান নগরবাসীর জন্য হাসপাতালের
প্রয়োজনীয়তা তথা রোগ-ব্যাধির প্রকোপ কমিয়ে দেয়। আধুনিক নগর ব্যবস্থায়
যেখানে কংক্রিটের জঙ্গল কেটে সবুজ অঞ্চল পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে, সেখানে
চট্টগ্রাম নগরীতে সবুজ ধ্বংস করে অতিকায় ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত আর যাই
হোক দূরদর্শিতার পরিচয় হতে পারে না। সিআরবি ভবনটির ঐতিহ্যগত বা 'হেরিটেজ'
মূল্যও ভুলে যাওয়া চলবে না। প্রায় দেড়শ বছর আগে নির্মিত এই ভবন ও সংলগ্ন
এলাকা বরং এখন সংরণে মনোযোগী হওয়া জরুরি।
আর এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ
হওয়ারও প্রয়োজন নেই যে, একটি হাসপাতাল মানে শুধু ভবন নয়। এর সঙ্গে গড়ে উঠবে
'প্রয়োজনীয়' দোকানপাট, পার্কিং এরিয়া ও আবাসিক ভবন। হাসপাতালের বিবিধ
'সম্ভাবনা' বিবেচনায় বেসরকারি আবাসিক স্থাপনার ভিড়ও বাড়তে থাকবে বৈকি।
সমকালের কাছে কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেনের এই আপে যথার্থ যে, 'উন্মুক্ত
পরিসর না থাকলে মানুষ যাবে কোথায়?' আমরা দেখছি, নাগরিকরা তো বটেই, খোদ
রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীরাও এখানে হাসপাতাল নির্মাণের বিপ।ে নাগরিক ও
শ্রমিক-কর্মচারীদের আপত্তি সত্ত্বেও সিআরবি এলাকায় পিপিপি বা
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে হাসপাতাল নির্মাণে তোড়জোড়ের মূল কারণ কী, তাও
খতিয়ে দেখতে বলি আমরা। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে সামষ্টিক স্বার্থ
জলাঞ্জলি দেওয়ার নজির আমাদের দেশে কম নেই। এেেত্রও তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে
কিনা, সময় থাকতেই অনুসন্ধান জরুরি।
ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ
রেলওয়ে শ্রমিক লীগ প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি এবং রেলওয়ের বিভিন্ন
দপ্তরে চিঠিও দিয়েছে। তাদের এই বক্তব্য যথেষ্ট যুক্তিসংগত যে, শহরের অদূরে
কুমিরায় রেলের যে পরিত্যক্ত বব্যাধি হাসপাতাল রয়েছে, তার আশপাশে খালি পড়ে
থাকা কমবেশি ১০ একর জমিতে প্রকল্পটি স্থানান্তর করা হোক। আমরা আশা করি,
কর্তৃপ বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনা করবে। নগরবাসীর আপত্তি ও প্রকৃতির আকুতি মেনে
নিয়ে হাসপাতালের জন্য বিকল্প স্থান খোঁজা হবে। রেলওয়ে কর্তৃপরে প্রতিও
আমাদের অযাচিত উপদেশ- জনকল্যাণে ব্যবহূত স্থান ও স্থাপনাগুলোর 'বাণিজ্যিক'
ব্যবহারে অতি উৎসাহী না হয়ে তাদের উচিত ইতোমধ্যে দখল হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো
পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হওয়া। তাতে করে যেমন 'নেই কাজ তাই খই ভাজ' পরিস্থিতি
দূর হবে, তেমনই কমবে অকাজের আশঙ্কা।