ড. জেবউননেছা ||
সময়টা
২০১৯ সাল। একমাত্র ছেলে জ্বরে আক্রান্ত। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার
মধ্যে সে মাঝে মাঝেই অচেতন হয়ে পড়ছে। তখন রক্ত পরীা করে জানা গেলো সে
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। প্রায় ১২ দিন ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি রেখে
সুস্থ করে বাড়ি ফিরেছিলাম। আর এই ১২ দিনে তার শরীরে রক্তের প্লাটিলেট হ্রাস
বৃদ্ধি, ফুসফুসে পানি নামা বিভীষিকার গল্পখানি নাই করলাম। অতঃপর ২০২০ সালে
রোগীর সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে বেড়েছে ২.৭ গুণ। ২০২০ সালে আক্রান্ত হন
১৪০৫ জন।
২০২১ সাল। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক। দীর্ঘ ১৫ দিন আইসিইউতে ছিলেন তিনি। রেখে
গিয়েছেন পাঁচ বছরের বাচ্চা। এই শিকের মৃত্যুর পর জানতে পারি কয়েক দিন আগে
শরীয়তপুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শিানবিশ আইনজীবী মৃত্যুবরণ করেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী,
রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে ১৭৯ জন ভর্তি হয়েছেন।
গত ১০ দিনেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২৮১ জন। তবে উল্লেখযোগ্যভাবে গত ২০ দিন ধরে ঢাকায় বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।
ঢাকায়
যে স্থানটিতে আমি বর্তমানে বাস করি, সেখানটায় মাঝে মাঝে চোখে পড়ে মশা নিধন
ওষুধ ছিটানো কর্মীদের। সব সময় চোখে পড়ে না। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার
দুই সিটি করপোরেশনের নেওয়া ২০১৯ সালের দিকে উদ্যোগ চোখে পড়েছিল। যেমন, ওষুধ
ছিটানো, বিনামূল্যে মশার ওষুধ বিতরণ, তারকাদের নিয়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযান
করে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এরপর থেকে তেমন
কোনও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়েনি। তবে ডেঙ্গু রোগী যখন বেড়ে যায় তখন
কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, প্রকোপ বন্ধ হলে কার্যক্রম স্থবির করে ফেলা ডেঙ্গু
প্রতিরোধে কার্যকর পদপে নয়। কারণ, ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা
তাৎণিকভাবে নির্মূলের ব্যাপার নয়। এর বিরুদ্ধে সারা বছর কাজ করতে হবে।
এক
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১১টি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ
মাত্রায় ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাসের বাহক এডিস মশার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে
এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীতে প্রতিবছর ৫০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে
আক্রান্ত হন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৫ লাখ রোগীর মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার
মৃত্যুবরণ করে। যার একটি বড় অংশ শিশু। ১৯৬০ সাল থেকে ২০১০-এ ডেঙ্গুর ঘটনা
৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ষাটের দশকে এ দেশে এ জ্বরকে ‘ঢাকা ফিভার’ বলা হতো।
তবে ১৮৭১-১৮৭২ সালের দিকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এর প্রাদুর্ভাব দেখা
দিয়েছিল। দণি এশিয়ায় দেখা দেয় ১৯৭৫ সালে। তবে আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে
বেশি হয়েছিল ২০১৯ সালে। এ বছর জুন মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ২৭১ জন, যা
চলতি বছরের মোট শনাক্তের হার ৬৯%। তবে ঢাকা ছাড়াও ডেঙ্গুজ্বর ছড়িয়ে পড়েছে
গ্রামেও।
কিন্তু কেন এই ডেঙ্গুজ্বর ছড়িয়ে পড়েছে তার কারণগুলো বিশ্লেষণ
করলে দেখা যায়, আমরা নাগরিকেরাই যথেষ্ট সচেতন নই। আমাদের অব্যবহৃত পানির
বোতল, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলদানি জমিয়ে রাখি। আমাদের স্থাপনার পাশের
জায়গাতে যে পানি জমে থাকে, তা ল করি না। সপ্তাহে একদিন বাড়ির চারদিক পরীা
করি না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শেষে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্লিচিং পাউডার ছিটাই
না। বাসার ময়লা, আসবাবপত্রের ফাঁকে যে মশা লুকিয়ে থাকে তার অস্তিত্ব খেয়াল
করি না। রাতে মশারি ব্যবহার করি না, দিনের বেলায় যারা আরাম করে ঘুমান তারা
তো নয়ই। এদিকে যাদের বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় আছে, তারা অলসতা করে ও পরিষ্কার
করতে চায় না। আবার অনেক সময় দেখা যায়, পরিষ্কার করার লোক খুঁজলেও লোক খুঁজে
পাওয়া যায় না।
যেদিকে আমাদের ৬০% মানুষের মশা মারার ওষুধ কিংবা কয়েল
ক্রয় করার পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এ তো গেলো ব্যক্তি-বিষয়ক ডেঙ্গু বিষয়ক
সচেতনতার অভাবের কথা। ঢাকার এমনও স্থান আছে, যেখানে শেষ কবে মশার ওষুধ
ছিটানো হয়েছে সে এলাকার বাসিন্দারা বলতে পারেন না। আমারও চোখে পড়ে না তেমন
কোনও উদ্যোগ।
হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, ক্যান্টিন, রান্নাঘর
অপরিচ্ছন্ন। টয়লেটগুলোতে পানি জমে থাকে। হাসপাতালে পাখা থেকে শুরু করে
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রগুলো পরিষ্কারের উদ্যোগ নেই। বিভিন্ন রেস্তোরাঁর
রান্নাঘরগুলোও নোংরা থাকে। বর্জ্য ফেলার স্থান অরতি থাকে। আসলে ব্যক্তিগত
সচেতনতাই মুখ্য বিষয়। সেইসাথে দরকার সামাজিক সচেতনতা। তার পাশাপাশি সরকার
কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগ।
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে মশা নিধন ওষুধ ছিটানোর জন্য
জনবল বাড়ানো, কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শ গ্রহণ করা, কীটতত্ত্বের জন্য
প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা দরকার। নিয়মিত পর্যবেণ করা, বরাদ্দকৃত বাজেটের
অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে কড়া নজর রাখা এবং জবাবদিহি বৃদ্ধি করাও প্রয়োজন। বিশেষ
করে মশা নিধনের জন্য সরকার কর্তৃক যে বাজেট বরাদ্দ করা হয় কমপে সে বাজেটের
অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে সমাজের শিতি এবং সচেতন মানুষের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে
মশকনিধন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। যেসব নির্মাণাধীন
ভবন রয়েছে সেসব ভবনে লার্ভা বিস্তার যেন করতে না পারে, সেদিকে যতœশীল হওয়া
জরুরি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনও দোকানে ডাব কিনে পানি পান করার পর
দোকানিকে বলি, ডাবের খোসা দুই ভাগ করুন এবং নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিন।
কারণ, ডাবের খোসার ভেতরে এডিস মশা ডিম পাড়ে। করোনার আগে বিভাগের শেষ
শিাসফরে শিার্থীদের নিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পাশের সাগর পাড় পরিষ্কারের
উদ্যোগ গ্রহণ করি। শিার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিকরা তাদের শিা প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার রাখার বিষয়ে
শিার্থীদের সম্পৃক্ত করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোর
রান্নাঘর এবং ক্যান্টিন পরিষ্কার রাখার জন্য প্রশাসনকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন
করা প্রয়োজন।
যেকোনও মহামারি সরকার একা মোকাবিলা করতে পারে না, যদি না
তার সঙ্গে জনগণ সম্পৃক্ত হন। কারণ এসব মহামারিতে সামাজিক সচেতনতাই মুখ্য।
সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস থাবা দিয়েছে। এই ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য আমারা যদি
নিয়মিত মাস্ক না পরি, সামাজিক দূরত্ব না মেনে চলি, তাহলে তো ভাইরাস
ফাঁকফোকর খুঁজবেই। অবাধ চলাচলে এখন করোনাভাইরাস আমাদের থাবা দিয়েছে গ্রাম
থেকে শহর পর্যন্ত। সঙ্গে ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রতিদিনই
ডেঙ্গু রোগীর তালিকা বড় হচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা
শ্রমিকদের বিনামূল্যে মশার কয়েল বিতরণ করতে পারেন অথবা মশারি দান করতে
পারেন। তাদের শিল্প-কারখানা পরিষ্কার রাখার জন্য শ্রমিকদের সংযুক্ত করতে
পারেন। ঢাকার বিলবোর্ডগুলোতে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা যেতে পারে।
মসজিদের ইমাম খুতবায় এবং ধর্মীয় পুরোহিতগণ তাদের ধর্মীয় সভায় ডেঙ্গু বিষয়ে
কথা বলে সচেতন করতে পারেন। কারণ, সব ধর্মে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়ে
বর্ণনা করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম, গণমাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানারকম
বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এলাকার জনগণকে নিয়ে
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে
পারেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রশাসন মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত
পরিচালনা করতে পারেন।
যদিও সম্প্রতি দুই সিটি করপোরেশনের চিরুনি অভিযান
পরিচালনা করছে। নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি গ্রহণ, বস্তিগুলোতে
নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর পদপে গ্রহণ করা জরুরি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের
প্রধান মাঝে মাঝে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে
পারেন। সবকিছুর মূলে যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো ‘দেশপ্রেম’ এবং
‘মানবপ্রেম’। এই দুই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সব মহামারি মোকাবিলা করা জরুরি।
লেখার
শুরুতে আমার ছেলের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কথা অবতারণা করেছিলাম। এর কারণ
হলো, সে যখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, তার বয়স তখন ১২। আমি সচ্ছল অভিভাবক বলে
তাকে পৃথিবীর আলো বাতাসে বিচরণ করাতে পারছি। কিন্তু এই অবস্থা যদি একটি
দরিদ্র পরিবারে হতো। তার বাচ্চা ফিরে আসতো কিনা জানি না। উচ্চবিত্ত থেকে
নি¤œবিত্ত পর্যন্ত প্রতিটি প্রাণ গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী
অনুপাতের দিক থেকে শিশুরাই বেশি। এই শিশুদের রা করতে হবে ডেঙ্গু থেকে। যে
দেশে বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছেন, সে দেশে নিশ্চয়ই
একদিন ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কার হবে, আমি এই প্রত্যাশা করতেই পারি। তার জন্য
সুযোগ ও মূল্যায়ন করতে হবে চিকিৎসকদের। আর চিকিৎসকদের আন্তরিক গবেষক হতে
হবে। একই সপ্তাহে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক এবং একজন শিানবিস আইনজীবীর
ডেঙ্গুতে মৃত্যু আমাকে আতঙ্কিত করেছে। এদের অবস্থায় কখন আমাকে পড়তে হয় এই
ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকছি প্রতিণ। এখনই সময় সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে
ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একজন একজন করে প্রতি ঘরে
দেশপ্রেমিক পাবো তো এই অমাবস্যার অন্ধকারে? যারা ব্যক্তিস্বার্থ রার চেয়ে
সামাজিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিবে বেশি। কারণ, সামাজিক স্বার্থের মূল্য
বেশি। এই স্বার্থটি সব সময় দেশের, দশের, সমাজের এবং সবার আদর্শ সাধনায়
আত্মনিয়োগ করেন।
লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।