ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রোহিঙ্গাদের ‘পাসপোর্ট’ নবায়নের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে
Published : Saturday, 17 July, 2021 at 12:00 AM
রোহিঙ্গাদের ‘পাসপোর্ট’ নবায়নের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবেসৌদি আরবের ‘চাপে’ বহুল আলোচিত ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার মেয়াদোত্তীর্ণ বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার- বুধবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের এমন ভাষ্য আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এ যেন বাংলা ভাষায় প্রায় প্রবাদে পরিণত হওয়া 'আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান' রবীন্দ্রসংগীতেরই নামান্তর। অস্বীকার করা যাবে না, ২০১৯ সাল থেকেই ঢাকার ওপর এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে আসছে রিয়াদ। বিভিন্ন সংবাদপত্রে এ বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করার বিন্দুমাত্র অবকাশ রয়েছে বলে আমরা মনে করি না। বস্তুত এর মধ্য দিয়ে ত্রিমাত্রিক বিপদ ডেকে আনা হবে। প্রথমত, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যে অনিয়ম ও প্রতারণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছে, সেটাকেই বৈধতা দেওয়া হবে। এর ফলে আরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একই উপায়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে উৎসাহিত হবে। দ্বিতীয়ত, এতে সৌদি আরবে অবস্থানরত অন্যান্য রোহিঙ্গা তো বটেই, এশিয়ার আরও নানা দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়ন করে স্থায়ী নাগরিকত্ব পেতে চাইবে। সৌদি আরবের পথ অনুসরণ করে অন্যান্য দেশও সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ‘বোঝা’ বাংলাদেশের কাঁধে চাপাতে চাইবে।
ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়েও একই ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। তৃতীয়ত, এতে এসব রোহিঙ্গার নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের দূরবর্তী সম্ভাবনাও ক্রমে ীণ হয়ে আসবে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের উচিত হবে না এই 'ফাঁদে' পা দেওয়া। এ কথাও মনে রাখতে হবে, জটিল বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রত্যেক দেশই নিজ নিজ স্বার্থে ‘চাপ’ দিতে চাইবে। কিন্তু সেসব বিবেচনা করে বাংলাদেশের নীতি ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারিত হতে পারে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তো প্রশ্নই আসে না। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ নানা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের চাপ এসেছে। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নিজের মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটাও ভুলে যাওয়া চলবে না, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম বিভিন্ন দেশের চোখরাঙানি উপো করে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে অন্য দেশের চাপে গোদের ওপর বিষফোড়া মেনে নেব কেন? আমরা মনে করি, বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও এ ব্যাপারে আর অগ্রসর না হওয়াই উচিত। এ বিষয়ে পরিপত্র জারির সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসার বিকল্প নেই।
আমরা জানি, সত্তরের দশকে সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ বদান্যতা দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের সে দেশে 'আশ্রয়' দিয়েছিলেন। তাদের একটি অংশ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করেছে সত্য; কিন্তু তার ফলে তারা তো বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে যায়নি। এরই মধ্যে কমবেশি ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা সামলাতে হিমশিম খাওয়া বাংলাদেশ নতুনতর বোঝা গ্রহণ করবে কোন যুক্তিতে? আমরা বরং মনে করি, সৌদি আরবে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা কীভাবে পাসপোর্ট পেয়েছে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া উচিত। এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ যদিও বলেছেন, যদি একবার দেওয়া পাসপোর্ট 'বৈধ' হয়, তাহলে সেটা নবায়ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমদের প্রশ- ভুল ঠিকানা ও ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে সংগৃহীত পাসপোর্ট বৈধ হয় কীভাবে? ওই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের পে সাময়িক ভ্রমণনথি দেওয়াও উচিত হবে না। বরং উচিত হবে বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোনো দায়-দায়িত্ব না নেওয়া।
রোহিঙ্গাদের এভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্টপ্রাপ্তির বিরূপ প্রভাব হবে বহুমাত্রিক- মনে রাখতে হবে। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেও আমরা একাধিকবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রাপ্তির কুফল হবে বহুমাত্রিক। এখন তা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দশকের পর দশক ধরে যে রাষ্ট্রীয় ও জাতিগত নিপীড়ন চলছে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চয় সহানুভূতিশীল। ২০১৭ সালের আগস্টে আসা রোহিঙ্গাদের কেবল নয়, নব্বইয়ের দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে দল বেঁধে বা বিচ্ছিন্নভাবে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এটাও সত্য, বাংলাদেশের সদিচ্ছা অবারিত হলেও সামর্থ্য সীমিত। এখন বরং রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সৌদি আরবসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরই এগিয়ে আসা উচিত।