মো. হাবিবুর রহমান, মুরাদনগর ||
শত বছরের ঐতিহ্যবাহী পুরানো নৌকার হাট কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও এ বাজারটিতে ব্যবসায়ীরা নৌকার সারি সারি স্তুপ করে সাজাতো। বর্তমানে অল্প সংখ্যক নৌকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা এ বাজারে আসে। পানি না হওয়ার কারণে ক্রেতাদেরও নেই আনাগোনা। বিক্রির আশায় তীর্থের কাকের মতো বসে থাকে নৌকা বিক্রেতারা। অল্প সংখ্যক বিক্রি হলেও লাভের মুখ দেখছেনা নৌকা প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীরা। এমন চিত্রটি ফুটে ওঠেছে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর বাজারে। এ অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়েছেন নৌকা কারিগর ও ব্যবসায়ীরা।
উপজেলার ৪০ বর্গ কিলোমিটারের উপর দিয়ে গোমতী, তিতাস ও আরসি নদী বয়ে গেছে। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে নীচু অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর একমাত্র ভরসার যানবাহন নৌকা। পার্শ্ববর্তী ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর ও কুমিল্লার হোমনা উপজেলার নিন্মাঞ্চলে বসবাসকারীরা সাধ্যের মধ্যে নৌকা কিনতে রামচন্দ্রপুর বাজারের হাটে আসেন। নিম্নাঞ্চলের মানুষের মালামাল পরিবহন ও যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয়ে উঠেছে নৌকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঐতিহ্যবাহী রামচন্দ্রপুর বাজারে সাধ্যের মধ্যে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য রয়েছে নানা ধরনের নৌকা। বড় কয়েকটি নদীতে পানি বাড়ায় ধীরে ধীরে খাল-বিলগুলোতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। উপজেলার ভিতর ও আশ-পাশের কয়েকটি উপজেলা থেকে নৌকার ক্রেতা ও বিক্রেতারা আসছেন এই শত বছরের পুরানো নৌকার হাটে।
জানা যায়, উপজেলার ১৭১টি খাল বেদখল হয়ে যাওয়ায় নৌকার ব্যবহার আগের মতো আর হচ্ছে না। আগে নৌকা দিয়ে মানুষজন আত্মীয়-স্বজণের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন, আর জেলেরা নৌকা দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং খালের পানি দিয়ে জমি চাষাবাদ করতেন কৃষক। এখন এই খালগুলি ভরাট হয়ে যাওয়ায় নৌকার ব্যবহার তেমন হচ্ছে না। যেখানে বছরের দুই মাস রামচন্দ্রপুর মিস্ত্রী পাড়ার মিস্ত্রিরা ব্যস্ত সময় পার করতেন ও নৌকা দিয়ে জেলেরা মাছ ধরতেন, এখন তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে এবং উপজেলার অনেক আবাদি জমি পানির অভাবে অনাবাদি থেকে যায়।
নৌকা প্রস্তুতকারক সুবল ও বিমলসহ ৪/৫জন জানায়, বর্ষা এলে নৌকা তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করতাম, এখন নৌকার চাহিদা অনেক কমে গেছে। যারা নৌকা নিতে বাজারে আসছেন, তারা উচিতমূল্যের চাইতে আরো কম দাম বলছেন। অনেকেই এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে অটো রিকশা চালাচ্ছেন। সরকার দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার করলে এবং বিভিন্ন প্রনোদনা বা সুদমুক্ত ঋণ দিলে বাঙ্গলির ঐতিহ্য নৌকা শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবেন। তা না হলে নৌকা শুধু পোস্টারেই দেখা যাবে, বাস্তবে থাকবে না।
রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সরকার দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে বলেন, আমার দাদার কাছ থেকে এই নৌকা হাটের গল্প শুনেছি। এখন যেমন রাস্তায় গাড়ির জটলা থাকে তেমনি একশত বছর আগেই নৌকার জটলা থাকতো এ হাটে। আশ-পাশের ৫ উপজেলার মানুষ নৌকা দিয়ে এসে এ বাজারে ক্রম-বিক্রয় করতেন। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে নৌকার ব্যবহার কমে যাওয়ায় এ শিল্পটা বিলীন হওয়ার পথে। নৌকা তৈরীর অনেক মিস্ত্রী ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন। সঠিক প্রদক্ষেপ নিলে এ শিল্পটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিষেক দাশ দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে বলেন, নৌকা বাঙালি জাতির ধারক বাহক। কি ধরণের সহযোগিতা পেলে এ ঐতিহ্য টিকে থাকবে তার একটা সুস্পষ্ট ব্যাখা আমাদেরকে দিলে, আমরা বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেকে অবহিত করব।