জয়শ্রী দাস ||
বিশ্বজুড়ে
স্মার্টফোনের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্মার্টফোনের
অপব্যবহার। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের স্মার্টফোনের অপব্যবহার নিয়ে অভিভাবকরা
চরম উৎকণ্ঠায় আছেন। সেদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরছি। বিজয় সরণির রাস্তায় গাড়ি
জ্যামে আটকে গেল। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ফুটপাতে বসে এক নারী অন্য
নারীর মাথার চুল বেঁধে দিচ্ছে। তাদের কোলঘেঁষে তিন-চার বছরের এক শিশু
আপনমনে স্মার্টফোন নিয়ে কার্টুন দেখছে। নিজের ঘর থেকে শুরু করে বিত্তহীন ও
বিত্তবৈভবপূর্ণ পরিবারসহ সব জায়গায় এখন শিশুদের হাতে স্মার্টফোনের ব্যবহার
দেখা যায়। বিশেষ করে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে এ অবস্থা আরও বেশি ল করা
যাচ্ছে। শহরাঞ্চল থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত সব স্থানেই সম-অবস্থা।
শিশুদের মোবাইলে আসক্তির কারণ ও প্রতিকারগুলো নিয়ে আলোচনা করি।
ক.
করোনাকালীন শিশুরা ঘরবন্দি: করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ। ঘরবন্দি
সবাই। পড়ালেখার চাপ কম থাকায় ঘরবন্দি অবস্থায় সময় কাটানোর জন্য মোবাইলে
শিশুরা আসক্ত হচ্ছে। শূন্য থেকে দশ বছর পর্যন্ত শিশুদের আসক্তির ধরন এমনÑ
যখন সে কাঁদছে তখন মোবাইল, যখন খাচ্ছে তখন মোবাইল, এমনকি পটি করার সময় তার
মোবাইলের প্রয়োজন হয়। যখন দশটা শিশু একসঙ্গে বসে মিষ্টি মিষ্টি করে কথা
বলার কথা তখনো সবার হাতেই একটা করে স্মার্টফোন। সে ফোন তারা কেউ শুয়ে
দেখছে, বসে দেখছে, ঘুমিয়ে দেখছে। চিন্তা করা যায় তাদের চোখের অবস্থা,
সারাটা দিন মোবাইলের নীল আলো তাদের মনের ও চোখের অবস্থার করুণ করে দিয়ে
যাচ্ছে। খাওয়ার সময় মোবাইল দিয়ে খাবার ফলে তাদের খাবারে রুচি নষ্ট হয়ে
যাচ্ছে। কী খাচ্ছে সেটার স্বাদ তারা পাচ্ছে না। টক-ঝাল-মিষ্টি সবই এক।
খাবারের সময় শিশুটি মনোযোগী কার্টুন বা গেমে সে কী করে খাবারের স্বাদ
আস্বাদন করবে।
করোনাকালীন সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দশ থেকে আঠারো বছর
বয়সী কিশোর-কিশোরীদের। মোবাইলের আসক্তি চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে তাদের।
রাতদিন ঘুম নেই, হতাশায় ভুগছে তারা। কিশোরদের ভালোলাগার একটাই মাত্র জায়গা
মোবাইলের গেম। গ্রাম, শহর, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত, উচ্চবিত্ত সবার পছন্দ
গেম। গ্রামের শিশুরাও মাঠে খেলতে পছন্দ করে না। তারা একসঙ্গে হয়ে একটি
স্মার্টফোনের মাধ্যমে গেম খেলছে। মা-বাবারা সন্তানের চিৎকারে, কান্নায়
অতিষ্ঠ হয়ে গৃহপালিত প্রাণী পর্যন্ত বিক্রি করে জোগান দিচ্ছে ফোন কেনার
টাকা। বইয়ের সঙ্গে আমাদের সন্তানরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে মোবাইলের সঙ্গে
সংযোগ স্থাপন করেছে। কিশোর-কিশোরীরা শুধু স্মার্টফোনের মাধ্যমে গেম খেলছে
না, তারা জড়িয়ে পড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের মতো নানাবিধ অপরাধে। কিশোর বয়সের
ছেলেমেয়েরা বর্তমানে ‘প্রাইভেসি’ নামের একটি শব্দ নিয়ে ধোয়া তুলছে। কী
ভয়ঙ্কর পরিণতি এই প্রাইভেসির। দরজা বন্ধ করে একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমে
মাদকসহ নানা গোপন সংগঠনে জড়িয়ে পড়ছে, বেড়ে যাচ্ছে এমনকি আত্মহত্যা, খুনসহ
নানা অপরাধ। আবার অনলাইনে কাস দরজা বন্ধ করতে হবে। অভিভাবকরা কোনো কথা বললে
বা বাধা দিলেই কিশোররা হিংস্র হয়ে ওঠে। তাদের চিৎকারে ভয় পেয়ে অভিভাবকরা
চুপ করে থাকেন। তাহলে এসবের জন্য দায়ী কারা?
খ. বুদ্ধির চর্চা নেই, নেই
জ্ঞানের চর্চা : করোনাকালীন এটি একটি বিশেষ সময়। বর্তমানের শিশুরা অনেক
সময় ধরে বাড়িতে অবস্থান করতে পারছে। খুব সহজেই তারা এ সময় একটি
বিজ্ঞানচর্চার কাজে ব্যয় করতে পারে। কিছুদিন আগে একটি প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেণ
করতে গেলাম, সেখানে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের দুজন ছাত্র
ঢাকা শহরের ময়লা-আবর্জনা দিয়ে বায়োগ্যাস তৈরি করছে। করোনাকালীন
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তারা দেশ-বিদেশের বই পড়ালেখা করে এই প্রজেক্টটি
দাঁড় করিয়েছে।
গ. প্রকৃতি সম্পর্কে অবহেলা : তিনবেলা ভাত খেয়ে-পরে বেঁচে
আছি কিন্তু আমাদের সন্তানরা অনেকেই জানে না ধান কীভাবে চাষ হয়, গরু পালন,
মাছ চাষ এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। সকালের সূর্য, নীল আকাশ, বর্ষার কালো
মেঘ, ঝিরিঝিরি কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি কিছুই তাদের ভালো লাগে না। তাই এ
শিশুদের প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। ঘরবন্দি এখন তাই বারান্দা দিয়ে
যতটুকু আকাশ দেখা যায় তার বর্ণনা তো শিশুদের কাছে আমরা করতে পারি।
ঘ.
খেলাধুলার প্রবণতা : শহরে মাঠের সংখ্যা হাতেগোনা। তবুও কষ্ট করে অভিভাবকদের
শিশুদের মাঠে নিয়ে যেতে হবে। করোনার এই সময়টাতে ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়ামগুলো
করা যেতে পারে। এতে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ মতা বাড়বে। মোবাইল ফোন থেকে মুখ
ফিরিয়ে শরীরচর্চার দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। ঙ. বই পড়া থেকে দূরে থাকা :
আগে শিশু-কিশোরদের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল আকাশসম। বর্তমানে এ আকর্ষণ
শূন্যের কোঠায়। একুশে বইমেলায় শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা একটি কর্নার রয়েছে।
সেখানের রঙিন বইয়ের পসরা নিয়ে বসে প্রকাশনা সংস্থাগুলো। একটি মোবাইল ফোনের
দামে আমরা সন্তানের হাতে তুলে দিতে পারি কয়েক হাজার বই।
চ. দেশীয়
সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় : যে দেশে বসবাস সেই দেশের গান, কবিতা, দেশীয়
ঐতিহ্যবাহী দিনগুলো, স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে শিশুদের জানাতে হবে।
শিশুরা যদি দেশ সম্পর্কে না জানে তবে তো তারা ভিনদেশি এই মেয়ের জন্য
স্মার্টফোনের দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াবেÑ এটাই তো স্বাভাবিক।
ছ. মা-বাবার
আসক্তি : সন্তানদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে অভিযোগ প্রায় প্রতিটি মা-বাবার।
কিন্তু অনেক অভিভাবকের মাধ্যমে এই আসক্তির ভাইরাস ছড়িয়েছে শিশুদের মাঝে।
মূল বিষয়টি এমন আমি হলাম আমার সন্তানের আয়না, আমি যা করব সন্তানটি তাই করবে
সুতরাং নিজেকে আগে স্মার্টফোনের রঙিন দুনিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনের মাধ্যমে অভিভাবকদের কথা বলা, হাসি-ঠাট্টা, সমালোচনা,
অফিস রাজনীতি সবকিছু থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। দায়িত্ব এড়ানো যাবে না।
শুধু খাওয়ার সময় মোবাইল ছেড়ে দিই এমন কথা থেকে দূরে থাকুন। ঘুমের সময়,
খাওয়ার সময় দেশীয় গল্প বলুন। রাজা-রানি, মুক্তিযুদ্ধের, শিামূলক গল্প
শিশুরা মজা পায় এবং শুনতে চায়। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন কিংবা হিন্দি
ক্রাইম সিরিয়াল দেখা থেকে বিরত থেকে শিশুদের পছন্দের কোনো নাটক, গল্প
দেখাতে পারেন। গান, কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা, গাছ লাগানো এসব কাজে আমাদের
শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে। শিশুদের কান্না থামানোর জন্য মোবাইল ফোন না
ধরিয়ে দিয়ে একটু বুঝিয়ে কষ্ট করে তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করি। শিশুদের রা
করতে হবে, তাদের মধ্যে কোমলতা নিয়ে আসতে হবে, যৌথ পরিবারের বয়স্ক মানুষরা এ
বিষয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে সরকার যদি গেমের অ্যাপসগুলো
বন্ধ করে দেয় তবে আমাদের বাসা থেকে গেমের বিশ্রী শব্দের পরিবর্তে, শিশুদের
মিষ্টি হাসির শব্দ শোনা যাবে। তবেই আমাদের কোমলমতি শিশুদের আনন্দ উচ্ছলতায়
পৃথিবীটা রঙিন হয়ে উঠবে। শিশুকিশোরদের এই রঙিন পৃথিবী গড়ে তোলার দায়িত্ব
আমাদের সবার। তাই আমাদের উচিত স্মার্টফোনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে সবার
ভালোর জন্য স্মার্টফোনকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল শিখা খুবই জরুরি।
জয়শ্রী দাস : কথাসাহিত্যিক ও গবেষক