আব্দুল আজিজ মাসুদ ।।
১৯৯৬ সালে আব্দুল মতিন খসরু স্যারকে জননেত্রী শেখ হাসিনা আইন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, মফ:স্বল থেকে পাশ করে আসা একজন সংসদ সদস্য যার আইনজীবী হিসেবে উচ্চ আদালতে তেমন একটা পরিচিতিও নেই, তিনি কিভাবে আইনমন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চালাবেন? কিন্তু না, জননেত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্তে ভুল করেননি। আব্দুল মতিন খসরু স্যার আইন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই বেশকটি যুগান্তকারী পদপে হাতে নিয়ে প্রায় ঘুমন্ত মন্ত্রণালয়টিকে যেন জাগরিত করে তুললেন। প্রথমেই তিনি সংবিধান ও মানবতা বিরোধী কালো আইন ওহফবসহরঃু ড়ৎফরহধহপব বাতিল করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্মম হত্যাকা-ের বিচারের পথ উন্মুক্ত করেন। বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থাকে আমূল সংস্কার ও যুগোপযোগী করার ল্েয বিশ্ব ব্যাংকের ২০০কোটি টাকার আর্থিক সহায়তায় ইধহমষধবংয খবমধষ ধহফ লঁফরপরধৎু পধঢ়ধপরঃু নঁরষফরহম ঢ়ৎড়লবপঃ গ্রহণ করেন। সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনসহ সমগ্র বাংলাদেশের পুরাতন জরার্জীণ আদালত ভবনগুলোর অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন করেন। অসহায় মানুষের মানবাধিকার বাস্তবায়নে “জাতীয় মানবাধিকার কমিশন” গঠন করার ল্েয টঘউচ’র অর্থায়নে ওহংঃরঃঁঃরড়হধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং রহ ইধহষধফবংয (ওউঐজই) নামে একটি জাতীয় মানবাধিাকার প্রকল্প গ্রহণ করেন। পরে ১/১১ এর সময় ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’ গঠন করা হয়। তৃণমূল পর্যায়ে ছোটখাট বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে আদালতের মামলার জট কমানো, বিচার প্রার্থীদের হয়রানি লাঘবে থানা পর্যায়ে গ্রাম আদালত প্রতিষ্ঠার ল্েয টঘউচ’র অর্থায়নে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাছাড়া প্রচলিত আইন সমূহ পরীা নিরীা, যুগোপযোগী সংস্কার/ নতুন আইন প্রণয়নে সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করার জন্য “আইন কমিশন” গঠন করা হয়। ‘বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আইন সংশোধনী এনে ইনস্টিটটিউটকে উজ্জীবিত করে তুলেন। দলমত নির্বিশেষে দ,অভিজ্ঞ, নিরপ্রে বিচারপতি নিয়োগে সহায়তা করতে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে নিয়োগের জন্য প্রস্তাব করে সুপ্রিম কোর্টে প্রথম নারী বিচারপতি নিয়োগের দ্বার উন্মোচন করেন।
কুমিল্লা- ৫ সংসদীয় আসন বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়ায় ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা আব্দুল মতিন খসরু স্যার ৫ বার সাংসদ নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাচনেও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে কিছু সংখ্যক আইনজীবীর কুটকৌশল আর আঞ্চলিকতার বেড়াজালে দুই বার পরাজিত হন। ২০২১-২০২২ সালের নির্বাচনী পরিচিতি সভায় ভোটাদের নিকট তাঁর আবেদন ছিল তৃতীয় বার যেন তাঁকে সকলে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেন। দলমত নির্বিশেষে তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেন। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির ঐতিহাসিক দায়িত্ব বুঝে পাওয়ার আগেই মহামারি করোনায় পরপারে চলে যান। অসমাপ্ত রেখে যান আইনজীবীদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে পরিকল্পিত কাজসমূহ ।
তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রথমেই ছিল আইনজীবীদের দীর্ঘদিনের দাবি জীবদ্দশায় বেনেভোলেন্ট ও কনট্রিবিউটরি ফান্ডের সুবিধাভোগের ব্যাবস্থা করা। তিনি বলেছিলেন পেশায় ৩৫বৎসর অতিবাহিত হলে অন্তত ৫০% টাকা ফান্ড থেকে প্রদানের ব্যাবস্থা করবেন। এই বিষয়টি নির্বাচন এলেই সকল প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি থাকে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। তিনি বেনাভোলেন্ট ও কনট্রিবিউটরি ফান্ডের বৈষ্যম্য দূর করার ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বর্তমানে প্রস্তাবিত বহুতল ভবন নির্মাণে সরকারি বরাদ্দ এনে সঠিক সময়ে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করা, বার বেঞ্চের সুসম্পর্ক স্থাপন করাসহ মাননীয় প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করে মোশন বেঞ্চ বৃদ্ধি, পেনডিং আপিলের জামিনের বেঞ্চ, রোল শুনানির বেঞ্চ গঠণে যথাযথ পদে গ্রহণ করা ছিল তাঁর এবারে অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তাঁর এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো উত্তরসূরীদের দ্বারা বাস্তবায়িত হলেই তাঁর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।
আব্দুল মতিন খসরু স্যার সম্পর্কে আমার ফুফাতো ভাই । (আমার একমাত্র ফুফুর জ্যেষ্ঠ সন্তান) তাঁর উৎসাহ, উদ্দীপনায় আমার আইন পেশায় আসা। তিনি প্রায়ই বলতেন ‘আইনজীবী হও সারাজীবন কোট টাই পরে স্মার্ট হয়ে সমাজে সম্মান নিয়ে চলতে পারবে।’ ২০০৩ সাল থেকে স্যারের জুনিয়র হিসেবে তাঁর পল্টনের মেহেরবা প্লাজা চেম্বারে আসা যাওয়া শুরু করি । তখন চেম্বারে যাদেরকে নিয়মিত পেয়েছিলাম তারা হলেন, এডভোকেট পংকজ কুমার কুন্ডু, এডভোকেট রানা কাউছার , এডভোকেট মাসুদ রুমি (বর্তমানে ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল) ব্যারিস্টার মাকসুদুল ইসলাম, এডভোকেট হারুন-অর-রশিদ ফরিদকে, পরর্বতীতে পেয়েছি এডভোকেট শামীম খান (বর্তমানে সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল ) ব্যারিস্টার মহিউদ্দিন আহমেদ, নজরুল ইসলাম (বর্তমানে হোমনা পৌর মেয়র ) এডভোকেট আবু ইব্রাহীম, এডভোকেট তাফসির আহমেদ খান, এডভোকেট তসলিম আহমেদ খান, এডভোকেট গোলাম রাব্বানী শরীফ, এডভোকেট ইসকান্দার ভূইয়া আমির, এডভোকেট জাহেদুল আলম।
আইনজীবী সহকারী হিসেবে পেয়েছি, বাবু আশুতোষ দেবনাথ অর্থাৎ আমাদের আশুবাবুকে, কালের সাী আশু বাবু স্যারের আইন পেশার শুরুতে কুমিল্লায় মক্কেল হিসেবে এসে স্যারের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আইনজীবী সহকারী হিসেবে সাথে ছিলেন। আইনজীবী সহকারী হিসেবে আরও পেয়েছি সালাম, রেজাউল, জহির, রিপন, বাবলু, ছোটনকে।
বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়াসহ কুমিল্লার বহু নবীন আইনজীবী ইনটিমিশন জমা দেওয়ার সময় স্যারের জুনিয়র হিসেবে স্বার নিতেন এবং পরবর্তীতে তাঁর জুনিয়র হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করতেন, এমন সংখ্যা প্রচুর। স্যার ছিলেন বরাবরই উদার, আর এই উদারতার সুযোগে বহু আইনজীবী স্যারের নামে মক্কেল থেকে মোটা অংকের ফি নিয়ে স্যারকে সামান্য ফি দিয়ে মামলা করিয়ে নিতেন। ট্রান্সফার ব্রিফ হিসেবে নবীন প্রবীণ আইনজীবীদের মামলা করতেন প্রচুর কিন্তু ফি গুনে নিতেন না কখনো। কোন কারণে মামলা শুনানি না করতে পারলে পুরো ফি ফেরত দিয়ে দিতেন এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে বহু। অনেক কার্কতো স্যারের নামে মামলা বাগিয়ে অন্য আইনজীবীদের দিয়ে মামলা করিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিতেন, আবার আশানুরূপ ফল না পেয়ে এসব কার্ক বিপাকে পড়তেও দেখেছি, শেষে ঘুরেফিরে স্যারের কাছেই আসতে হতো।
২০১১ সাল সুপ্রিম কোর্টে সনদ হওয়ার পর স্যার আমাকে কোর্ট আঙ্গিনা থেকে একটা গাউন কিনে দিলেন, এই গাউনটা তিনি কখনো কখনো ব্যাবহারও করতেন, যখন তাঁর লন্ডনের গাউনটা বাসা থেকে ভূলক্রমে না আনতেন। তিনি আমাকে সব সময় বলতেন, আমার সাথে আঠার মত লেগে থাকবি, মামলা শুনানির কলাকৌশল পর্যবেণ করবি’। মামলা শুনানির আগে আমরা সাধারণত পিটিশনের প্রথম পৃষ্ঠায় সংপ্তি নোট লিখে দিতাম তিনি এর উপর দীর্ঘণ শুনানি করতেন।
২০১২/১৩ সালের দিকে মাননীয় বিচারপতি মো: আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞার কোর্টে এক আগাম জামিন শুনানির জন্য বসে আছি, শুনানি করবেন স্বয়ং স্যার কিন্তু তিনিতো আসছেন না, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে,আমার টেনশনও বেড়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আমাদের মামলার ডাক পড়ল। দাড়াঁলাম স্যারের কথা বলে সময় নিব বলে কিন্তু পিছনে ফিরে দেখি আসামি হাত জোড় করে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখেতো আমি ভয়ে হতভম্ব! এখন কি করি সময়তো নেওয়া যাবে না শুনানি করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত দুরু দুরু বে শুনানি করলাম এবং জামিনও পেলাম। শুনানি শেষে দ্রুত কোর্ট থেকে বের হয়ে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ নিয়ে স্যারের সাথে দেখা করলাম এবং এই সাফ্যল্যের কথা জানালাম। এই সাফ্যল্যে তিনি এতটাই আনন্দিত হলেন যে উপস্থিত সকলকে বলা শুরু করলেন এবং মামলার পুরো ফি টা আমাকে দিয়ে দিলেন।
তিনি আমাকে এতোটা স্নেহ করতেন যে, কোর্ট চেম্বার অর্থাৎ এনেক্স ভবনের ৩০০৬ নং করে তাঁর চেয়ারটিতে তাঁর অনুপস্থিতিতে আমাকে বসার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমার ড্রাফট করা মামলাগুলো অত্যন্ত মনোযোগসহকারে অভিজ্ঞ শিকের মতো দেখে দিতেন, প্রয়োজনে নতুন নতুন প্যারা সংযোজন করে ড্রাফ্টটিকে সমৃদ্ধ করে দিতেন, যে গুলো আমি এখনও সংরণ করে রেখেছি। ড্রাফ্ট সংশোধন করতে গিয়ে তাঁর বকা ঝকাও খেতাম। তিনি চাইতেন আমি একজন ভালো আইনজীবী হই কিন্তু তা আর হতে পারলাম কই।
আশির দশকে আর্šÍজাতিক সেবা সংগঠন এপেক্স কাবের সাথে শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক দেলওয়ার ভাইয়ের মাধ্যমে জড়িত হই। খসরু ভাই তখন সম্ভবত কাবের ন্যাশনাল ইন্টার ন্যাশনাল ডাইরেকটর (এন আই আর ডি) পরে তিনি লইফ গভর্নরও হয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাবে ১৯৮৯-৯০ সালে আমি বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় কাবের “সেক্রেটারি এন্ড ডিনার নোটিশ এডিটর” নির্বাচিত হই। এর পর তিন বার এ পদে নির্বাচিত হই। এ সময় তাঁর সাথে এপেক্সের জেলা ও জাতীয় কনভেশনে যোগদান, বন্যা র্দূগতদের সাথে ত্রাণ বিতরণত, চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
শৈশব থেকেই তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। তাঁর জীবনে এমন ঘটনাও আছে ট্রেন থেকে নেমে ওজু করতে গিয়ে ট্রেন মিস করেছেন। বিশাল জনসমাবেশ থেকে বেরিয়ে সময়মত নামাজ আদায় করেছেন। বাসায় হুজুর রেখে সহীহ্ শুদ্ধ ভাবে কোরআন তেলোয়াত করতে চেষ্টা করেছেন, বক্সীবাজারের বাসায় যারা গিয়েছেন তারা নিশ্চয় ল্য করেছেন তাঁর টেবিলের এক কোণে এক জিল্দ পবিত্র কোরআন শরীফ রাখা। তিনি মৃত্যুর আগপর্যন্ত সহ্হী শুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন পাঠের চেষ্টা করেছেন। হাদিসে আছে “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কোরআন শিা করে এবং অপরকে শিা দেয়”।
দোষে গুণে মানুষ , তাঁর দোষ ত্রুটি থাকতে পারে বা ছিল, আবার ভালো কাজেরও অভাব নেই। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তাঁর ভাল কাজগুলোর বিনিময়ে সকল দোষত্রুটি মা করে দিয়ে পরকালে উত্তম স্থান নসীব করুন।
লেখক : আইনজীবী , বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
মোবাইল: ০১৭১১-৪৬৪২১৩