কামরুল হাসান ।।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- তিনটি সূচকের সবক'টি পূরণ করে উন্নীত হয়েছে পরবর্তী ধাপে। বছরের শুরুতে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে, এই অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, রপ্তানি ও আমদানির গতি বাড়লে যা আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রধান পাঁচটি খাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা পরিমাণে এক লাখ ৪৮ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এ খাতে বিশেষ দৃষ্টিপেণ জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মোট ব্যবসার ৯০ শতাংশই ুদ্র ও মাঝারি মানের ব্যবসা। যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে ুদ্র্র ও মাঝারি শিল্প খাত। আমাদের দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলছে এই খাত। বিশ্বব্যাংক অনুমান করছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন চাকরির প্রয়োজন পড়বে। ুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা করা যেতে পারে। গত কয়েক বছরে দেশের ুদ্র ও মাঝারি খাতেই বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর ুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসা বড় হলে আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব দূরীকরণে সরকার এরই মধ্যে ুদ্র ও মাঝারি শিল্পে উদ্যোক্তা তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে।
কিন্তু দেশের বর্তমান ুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত বিশ্বের সঙ্গে আধুনিকতার দৌড়ে কতটুকু এগিয়ে? বিগত দশকে সারাবিশ্বে ব্যবসার ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলতি। ব্যবসা এখন অনেক বেশি ডিজিটালাইজড। প্রতিটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে পণ্য ও সেবা প্রদান করে। ভোক্তা সংস্কৃতিতেও এসেছে পরিবর্তন। ক্রয়মতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তারা এখন অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে কেনাকাটায় আগ্রহী। তাই যে কোনো পণ্য কেনাকাটার েেত্র অনলাইনে নির্ভরতা বেড়েছে। অনলাইন কেনাকাটা যেমন ব্যস্ত মানুষের সময় বাঁচায়, তেমনি সব বয়সী মানুষের জন্য সহজসাধ্য। বিশ্বস্ততা অর্জনের পাশাপাশি অনলাইন কেনাকাটা আধুনিক মানুষের জীবনকে আরও গতিশীল করে তুলেছে। বেশিরভাগ অনলাইন কেনাকাটার েেত্র ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবস্থা থাকায় গ্রাহকদের জন্য অনলাইনে কেনাকাটা অনেক বেশি সুবিধাজনক। করোনার মধ্যে অনলাইন কেনাকাটা বেড়ে গেছে বহু গুণ।
ক্রেতার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে বিক্রেতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে থাকলে ফেসবুক লাইভে পণ্য কেনাবেচা করতে দেখেনি, এমন মানুষ মেলা ভার। করোনায় কর্মসংস্থান হারিয়ে অনেকেই নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন এবং সফলতার মুখ দেখছেন। এ ছাড়া বৈশ্বিক মহামারির প্রকোপ কমাতে দোকানপাট বন্ধ এবং বিভিন্ন নিয়ম জারি থাকায় অনেক ব্যবসায়ী লোকসানের সম্মুখীন এবং অর্থকষ্টে পতিত। ফিউচার অব বিজনেসের হিসাব অনুসারে, বিগত বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের ভেতর ৫০ শতাংশ এসএমই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গ্রাহকের চাহিদার কথা বিবেচনা করে তাই ুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসায়ীরা অনলাইনে বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ফলে করোনার মধ্যেও দেশের ই-কমার্স দেখেছে প্রবৃদ্ধির মুখ। বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এসব উদ্যোক্তাকে সাহায্যে নানামুখী পদপে গ্রহণ করেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়নে সরকার দেশে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির প্রতি জোর দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, প্রতি ১০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর মতা রয়েছে। এরই মধ্যে ডিজিটালাইজেশন, প্রযুক্তির অগ্রগতি ব্যবসাসহ সব খাতে অসংখ্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ েেত্র ডিজিটালের সুফল ভোগ করার জন্য প্রথমেই ডিজিটাল খাতে দ ব্যবসায়ী গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য ুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য আইসিটি বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিণের আয়োজন বেশ ফলপ্রসূ হতে পারে। ২০১৩ সালে জার্মান রিটেইল ফেডারেশন এসএমই রিটেইলারদের জন্য 'এইচডিই টুলবক্স' নামে একটি টুলবক্স তৈরি করে, যা সহজে ুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অনলাইন ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও গাইডলাইন প্রদান করে। পাশাপাশি এখানে শিল্পসংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও অনলাইন ব্যবসার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে অবগত করার মাধ্যমে তাদের সহায়তা করে।
ভবিষ্যৎ কী বয়ে আনবে, তা কারও জানা নেই। তবে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা েেত্র প্রতিযোগিতা যেভাবে বেড়ে চলেছে, ইন্টারনেট বা প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যতীত অদূর ভবিষ্যতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। ব্যবসায় প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের ব্যবহার শুধু প্রতিষ্ঠানের জন্যই লাভজনক নয়; এর মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত হওয়া যায়। তাদের কাছে সুবিধাজনক উপায়ে পণ্য পৌঁছে দেওয়া ও তাদের চাহিদা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে অবগত হওয়া যায়। ুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের পণ্যের প্রচার ও ব্যবসার প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।
খুচরা ব্যবসা দেশের জিডিপি বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতের আধুনিকায়ন না হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেকাংশে পিছিয়ে যাবে। তাই এ খাতের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে ুদ্র্র ও মাঝারি ব্যবসার উদ্যোক্তাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দ এবং দোকানের পাশাপাশি অনলাইনে তাদের ব্যবসার সম্প্র্রসারণে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: কমার্শিয়াল ডিরেক্টর, সেলার মার্কেটপ্লেস এবং বিজনেস ইন্টেলিজেন্স, দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেড