একটি জংলি বিড়াল এবং রক্তাক্ত শবপালক
Published : Sunday, 1 August, 2021 at 12:00 AM
মানিকরতন শর্মা
চা’টায় একটু চিনি হলে ভালো হতো। কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় অনুপ্রদ। কারণটা সে জানে। গিন্নিকে বললে বলবেÑঅল্পএকটু চিনি আছে বয়ুমে। কেউ আইলে দিমুটা কি? এতো চিনি খাওনের দরকার নাই।’ অর্থাৎ অনেকগুলো কড়াকড়া শব্দ ধেয়ে আসবে আমার দিকে। কী দরকার, চিনি না হয় একটু কমই খেলাম। আবার মনে মনে ভাবে সকালের চা’টা যুতসই না হলে কী চলে! মনটাকে একটু ঘুরিয়ে; একটা নাতিদীর্ঘশ্বাস ফেলে- থাক্ অযথা কথা বাড়িয়ে কী লাভ!
এমন সময় ঘরের কোণায় কিচিরমিচির শব্দ। চড়–ইগুলো আজকাল বেশ শব্দ করে। কখনো একটা, কখনোবা স্বামীস্ত্রী মিলেই সমস্বরে শব্দ করে যায়। মনে হয় ওদের সংসারেও ওরা খুববেশী ভালো নেই। ভোর হতে না হতেই কিচিরমিচির কথা।
গত একমাস হল এই ভাড়াবাসায় ওঠেছে অনুপ। আগের বাসা থেকেও এই বাসাটা কিছুটা সস্তা। একরকম বাধ্য হয়েই এমন বাসা ভাড়া নিয়েছে সে। এইতো ক’দিন আগেও ভালোই ছিল সে। ডাইনিং টেবিলে সাজানো থাকত দুএক রকমের ফল। আত্মীয়স্বজনের প্রায়ই আনাগোনা থাকত ঘরে। ছেলেমেয়েরা বন্ধুদের সাথে মিশত হাসিখুশিতে। বৌ-সপ্তান্তে রিক্সার ফুট উচিয়ে মার্কেটে যেত। সেইসময় প্রায়ই রাত করে বাসায় ফিরত সে। প্রচ- খাটাখাটনি যেত তার উপর দিয়ে। সময়ের সাথে ব্যবসার ধরণ খাপ খাওয়াতে ভালোই মুনাফা আসত। কিন্তু বাদ সাধল অবিশ্বাস। একদিন হঠাৎ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা তুলে পার্টনার বন্ধু চলে যায়।ওলটো মোটা অংকের ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে দেয় সে। এখানে ওখানে লোকজনকে ধরে কয়েও শেষপর্যন্ত কিছুই হয়নি। তার ওপর অতিমারি নেমে আসে। যেন কাটা ঘায়ে লবণছিটা। রাতারাতি ধস নামে অনুপদের জীবনে। সূর্যালো যেন হঠাৎ রাক্ষসি মেঘে ঢেকে যায়। কিছুই ভাবতে পারে না। পতন্মুখ সংসারের মানুষগুলোও অপ্রস্তুত হয়ে যায়। চলে আসে সেই চিরচেনা টানাপোড়েনের চিত্র।
চিন্তুাগ্রস্ত অনুপ। পাকখাওয়া বর্ষার জলের মতো তারও ভাবনাগুলো দ্রুত বাড়তে থাকে। শরীর খারাপ দেখে একদিন একা একাই একটি ক্লিনিকে গিয়ে ডায়বেটিক পরীক্ষা করায়। ডায়বেটিক ধরা পড়ে। ডাক্তার বলেছে সকাল বিকাল হাঁটলে কন্টোলে চলে আসবে। হেঁটে বাসায় ফিরতে গিয়ে হাতে থাকা রিপোর্টটি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে পাশের ড্রেইনে ফেলে দেয় সে। ডায়বেটিকের কথা বাসায় আর বলে না অনুপদ। বিপদ যখন আসে তখন চতুর্দিক দিয়েই আসে। এটা বিপদের ধর্ম নয়, কপালের ধর্ম ভাবে সে।
মেয়েটা চোখের সামনে বড় হচ্ছে। ছেলে রূপও হাইস্কুলে ওঠেছে সবে। ব্যয়ের খাত বেড়েই চলেছে। সন্তান বড় হওয়ার পথেও চিন্তার ভাঁজ বড় হয়। কখন কী যে হয়! আজকাল কী বড়দের সঙ্গ, কী শিশুদের সঙ্গ, কোনো সঙ্গই নিরাপদ নয়। ঘটে যেতে পারে যেকোনো ঘটনা। কিছু একটা ঘটে গেলে তখন সামাল দেওয়া মশকিল হয়ে যায়। বিপদ এক ভয়ংকর পথ। যে এই খাদে একবার পড়েছে তার জীবন ছাড়খার হয়েছে।
পত্র-পত্রিকা, ইলেক্টনিক মিডিয়া কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোথাও কোনো স্বস্তির খবর নেই। অসহিষ্ণুতা গ্রাস করছে পুরো সমাজকে। সন্তান বড় হওয়ার এ এক উৎকণ্ঠাময় বিরম্বনা। সকালের ঝিরিঝিরি বাতাসে হাঁটতে গিয়ে নিজের সাথে কথাগুলো বলে অনুপ।
সংসারের জটলাগা কষ্টগুলোর সাথে সঙ্গ করতে করতে কখন যে দিন চলে যায় বলতে পারে না সে। স্ত্রী লিলা বেশ ভালো। সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতগুলো সামাল দিতে তারও চেষ্টার কমতি নেই। তবে কখনো কখনো সন্তানের চাহিদার সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সে। মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না।
নতুন বাসা। অমসৃণ ফ্লোর। ঘরকাজ, রান্নারকাজ, এসবেই বেলা চলে যায়। মেয়েটা কোনো কাজেই হাত দেয় না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। এই নিয়ে উচ্চবাইচ্চ কম হয়নি। মেয়ে বড় হচ্ছে। এখন কী আর যখন-তখন গায়ে হাত তোলা যায়! তবু মেজাজ হারিয়ে একদিন মেরে ছিল লিলা। তারপর রাগে অভিমানে পুরো একদিন না খেয়ে ছিল মেয়েটি। আজকালকার ছেলেমেয়েরা একটু বেশি সংবেদনশীল। হুটহাট কিছু একটা করে ফেলতে পারে। তাই মুখেই যা বলার বলে লিলা। ওদের কাছে মোবাইলটাই যেন পৃথিবী। খোলা আকাশের নিচে যে পৃথিবী তাকে আর বেশি টানে না।
বাপের বাড়ি খুব দূরে নয় লিলার। বছর তিনেক আগে বুদ্ধি করে কিছু টাকা দিয়ে বাপের বাড়িতে ধানীজমি কট রাখে সে। সেখান থেকে বছরের চাউল আসে। ফলে চাউলের চিন্তা করতে হয় না তার। বাজারে লাগামছাড়া চাউলের দাম। কথাটা মনে হলেই হাফছেড়ে নিশ্বাস নেয় অনুপ। সংসারের অনেকদিকই লক্ষ করে লিলা। মনে মনে তার প্রতি কৃতজ্ঞও হয় সে।
যে কক্ষে অনুপদ ঘুমায় ঠিক তার পশ্চিম কোণায় চড়–ইর ঘর। দুটো চড়–ই সারাক্ষণ ব্যস্ত। কখনো খরকুটো, কখনো খাবার নিয়ে। ওরাও নিজেদের মাঝে শান্তিতে থাকে না। কেবল রাত হলেই নিস্তব্ধ নিরবতা। ভাঙা ভেন্টিলেটর দিয়ে ওদের ঘরে আসা যাওয়ার পথ। ওদের সংসারে ক’দিন পর পর নতুন ছেলেমেয়ের জন্ম হয়। সময়ের পাকে ওরা বড় হতেই অপার গন্তব্যে আবার চলেও যায়। চড়–ইর সন্তানগুলো কোথায় চলে যায়, কোন আকাশে তার কোনো খবর থাকে না মা-বাবার।
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় অনুপের। বুকে কোলবালিশ নিয়ে অপরদিকে শুয়ে থাকে লিলা। হয়তো এখন স্বপ্ন দেখছে সে। ঘুম মানে তো স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন ঘুমকে জাগিয়ে দেয় নাকি ঘুম স্বপ্নকেÑভাবে অনুপ। ভাবনার দ্বারে এসে হঠাৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ওঠে বসে। লিলাকে ডাকবে! না, পরক্ষণে নিজেই বিছানা থেকে নামে। অন্ধকারে ডাইনিং রুমে আসে। হাতড়িয়ে গ্লাসে জল নিয়ে খায়। তারপর একটা ঢেক দেয় সে। মুখ দিয়ে বাতাস বেরুনোর ফলে বুকটা একটু হালকা অনুভব হয়। ভাবে আজতো সেক্লো খাওয়া হল না। মোবাইলটা বালিশের পেছন থেকে এনে তার লাইটটা ধরায়। বক্স থেকে সেক্লোটা খেয়ে একটু খাটে বসে জিরোয়। কিছুক্ষণ বসার পর একটু ভালো মনে হচ্ছে তার। ঘরের লাইট ধরায় না সে। পাছে লিলার ঘুম ভেঙে যায়। গাঢ়অন্ধকার ছাড়া ঘুমোতে পারে না সে। একটা আলো আসলেই হলো। ভোরে যখন ভাঙা ভেন্টিলেটর দিয়ে দিনের আলো আসে ঘরে তখনি জেগে ওঠে সে। তাই রোজ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে যায় লিলা।
হঠাৎ কিচিরমিচির করে ওঠে চড়–ইগুলো। এতো রাতে তো ওদের শব্দ করার কথা নয়-ভাবে অনুপ। সকালে ঘর ঝাড়– দিতে গিয়ে লিলা দেখে একটা ডিম ভেঙে পড়ে আছে ফ্লোরে। জায়গাটা পরিষ্কার করে। চা খেতে খেতে বলে, জান, আজ না চড়–ইর একটা ডিম পড়ে ভেঙে গেছে। লিলার কথায় উত্তর না দিয়ে ভাবে- তাহলে ওরা এই জন্যেই কাল রাতে এতো কিচিমিচির করেছে। হয়তো চড়–ইর ভাঙাবাসার কোনো এক ফাঁকগলে পড়েগেছে ডিমটা। লিলা কথাটা বলেই রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ করে একটা চেয়ার এনে চড়–ইর বাসায় উঁকি দিয়ে চোখ মেলে দেখে অনুপ। দেখে সেখানে একটা মাত্র ডিম রয়েছে।
হঠাৎ মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে বাপের বাড়ি যায় লিলা। সাথে ছেলেমেয়েরাও। ওরা মামার বাড়ি কথা শুনলেই একপায়ে খাড়া। বদ্ধঘরে বাচ্চারা কত থাকতে চায়! অতিমারির কারণে আজকাল যেখানে সেখানে বের হওয়া যায় না। রীতিমত ঘর হয়ে ওঠেছে কয়েদখানা। গ্রামের পরিবেশে অতিমারি এখনো এতোটা কাবু করতে পারেনি।
এদিকে তারও শরীর ভালো যাচ্ছে না। লিলাও বুঝতে পাড়ে। বলে, তোমাকে একা বাসায় রেখে যেতে মন চায় না। কিন্তু এদিকে মার শরীরও খুব খারাপ, কী যে করিÑবলে লিলা। শোন, তুমি কিন্তু শ্বাসকষ্টের অসুধটা নিয়ম করে খেয়ো। আবার ভুল্যা যাইওনা।
লিলা চলে যাবার পর শূন্যঘরে কেমন যেন অনুভব হয় তার। এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সাদামেঘের বৃষ্টি নামে। আউলা বাতাসের সাথে ছোট ছোট বৃষ্টির ফোটা মুখে ও শরীরে এসে পড়ে। বিষয়টা ভালো লাগে তার। এভাবে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
দুদিনের কথা বলে গেছে লিলা। কিন্তু শাশুড়ির শরীর তেমন ভালো নয়। তাই আসতে দেরি হবে বলে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে সে। শূন্যঘরে যতই ভালো খাবার থাকুক না কেন খেতে মন চায় না। একটা অমোঘ দুঃখ এসে মনকে গ্রাস করে। সঙ্গশূন্য মানুষ ভালো থাকে না কখনো।
ভোর হতে না হতে হঠাৎ চড়–ইর ঘরে প্রচ- ধস্তাধস্তি। এ রকম শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। এমনি বিছানা থেকে ওঠে বসে অনুপ। দেখে ঘরে ফ্যানের বাতাসে উড়ে পড়ছে চড়–ইর বাসাভাঙার খরকুটো। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তির শব্দ শেষ হয়। ঝাপ মেরে কী যেন হঠাৎ কিছু একটা চলে যায় ভেন্টিলেটর দিয়ে টের পায় সে। তাড়াতাড়ি করে একটা চেয়ার এনে উঁকি দিয়ে দেখে অনুপ। দেখে চড়–ইর শূন্যঘর। ভাঙাঘরের এদিকওদিক বেশ কতগুলো রক্তমাখা পালক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। আরেকটু ঘার উঁচিয়ে তাকায় অনুপ, দেখে গেইটের ওদিকটায় কুচকুচে কালো একটা জংলি বিড়াল গভীর আবেশে বসে বসে চোয়ালের ডানে একবার বামে একবার জিহ্বাটা চাটছে।
পরদিন রাতে আবার প্রচ- শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তার। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কী করবে সে! অসুধ তো খেয়েছে। যখন দেখছে আর পারছে না এমনি দুতলার বাড়িওয়ালাকে বিষয়টি ফোনে জানায়। তিনি তাড়াতাড়ি করে এই ভোর রাতে হাসপাতালে ভর্তি করায় তাকে। ভর্তির সাথে সাথে নার্স অক্সিজেন দেয়। অক্সিজেন লাগাতেই যেন জীবন ফিরে পায় অনুপ।
সকাল বেলা। চারদিক সুনসান নিরবতা। তখনো অনেক রোগী ঘুমিয়ে। বেডে শুয়ে শুয়ে দেখে অনুপ হাসপাতালের একটি ভাঙা ভেন্টিলেটরে চড়–ইর ঘর। দুটো চড়–ই একটু পর পর আসা-যাওয়া করছে। অন্যদিকে দেখে ফ্লোরে শুয়ে থাকা এক রোগীর পাশে বসে আছে কুচকুচে এক কালো বিড়াল।
লেখকঃ কবি গল্পকার আইনজীবী