বিশেষ
প্রতিনিধি ॥ ‘হে মহান, মহাবীর/ গর্ব তুমি বাঙালী জাতির/তুমিই তো জাতির
পিতা/ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তুমি রবে ততদিন/ বাঙালী জাতির হৃদয়ে/
যতদিন তোমার অর্জিত বাংলার পতাকার/ সেই লাল রক্তিম সূর্য উদ্দীপ্ত হবে/
বাংলার পূর্ব আকাশে।’
বাঙালীর জীবনে শোকগাঁথা রক্তাক্ত আগস্ট মানেই
শোকের মাস, বেদনার মাস। বছর ঘুরে আবার এসেছে বাঙালী জাতির ইতিহাসে রক্তের
আখরে লেখা শোকাবহ আগস্ট। আজ রবিবার শোকগাঁথা রক্তাক্ত আগস্টের প্রথমদিন।
শোকের মাসে প্রত্যয় ও শপথে শোককে শক্তিতে পরিণত করার অভয়মন্ত্রে আবার
উদ্দীপ্ত হবে বাঙালী জাতি। দেখতে দেখতে জাতির পিতা হত্যার কালো অধ্যায়ের ৪৬
বছর হলো। প্রাণঘাতী করোনার ছোবলে প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ ঃ দীর্ঘ
হচ্ছে। তবুও গতবছরের মতো এবারও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাসব্যাপী কৃতজ্ঞ
বাঙালী জাতি নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে স্মরণ করবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
বীর বাঙালীর ইতিহাসে
কলঙ্কিত এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে এ মাসেই। ইতিহাসের দীর্ঘপথ পেরিয়ে বাঙালী
জাতি পিতৃ হন্তারকের বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হলেও আমাদের
প্রতিটি শিরা উপশিরা ও ধমনিতে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করে এ মাস। ইতিহাসে হয়ত এ
মাসে অনেক বিজয়ের কাহিনী লেখা আছে। কিন্তু বিজয়ের সেসব কাহিনী রক্তের
স্রোতধারায় মিশেছে আগস্টে এসে। এ মাস নতুন করে ভাবতে শেখায়। এ মাস
প্রতিশোধের চেতনায় শানিত করে সবাইকে।
১৯৭৫ সালের এই মাসেই বাঙালী
হারিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানকে। ১৫ আগস্ট কালরাতে শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, একাত্তরের
পরাজিত ঘৃণ্য নরপশুরা একে একে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল,
শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালকে। জঘন্যতম এই
হত্যাকা- থেকে বাঁচতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব
সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, কর্নেল জামিলসহ
১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে।
পরাস্ত পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও তাদের
এ দেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রের নৃশংস শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার
তথা মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও চেতনা। এই শোকের মাসেই বাঙালীর স্বাধীনতার
স্থপতির বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল স্বাধীন শ্যামল বাংলার মাটি।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ত্যাগ, দূরদর্শিতা এবং অকুতোভয় আপোসহীন নেতৃত্বে দেশ
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল। বাঙালী জাতি পেয়েছিল
হাজার বছরের আকাক্সিক্ষত প্রিয় স্বাধীনতা, স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন
মানচিত্র। বজ্রকণ্ঠে তিনি ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। রক্তক্ষয়ী
মুক্তিযুদ্ধে রক্তনদী পেরিয়ে অর্জিত হয়েছিল মহার্ঘ্য স্বাধীনতা।
যে
বিশাল হৃদয়ের মানুষকে কারাগারে বিশাল হৃদয়ের মানুষকে কারাগারে বন্দী রেখেও
দেশে স্পর্শ করার সাহস দেখাতে পারেনি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, অথচ
স্বাধীন বাংলার মাটিতেই তাঁকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু
হত্যার সেই ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা আজও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। জাতির পিতাকে
হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি ৪৬টি বছর বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তার সুযোগ্য
উত্তরাধিকারিণী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর
দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা।
শুধু রক্তাক্ত ১৫
আগস্টই নয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের
প্রত্যক্ষ মদদে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল জাতির জনকের
কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে।
মৃত্যুজাল ছিন্ন করে ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও এই ঘটনায়
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও মহিলা আওয়ামী লীগের
সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়। তাই
আগস্ট মাস বাঙালীর জীবনে অভিশপ্ত মাসও।
তাই শোকার্ত বাঙালী জাতি পুরো
আগস্ট মাসজুড়ে গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন বাঙালী জাতির এই
মহানায়ককে। বুধবার দিবাগত রাতের প্রথম প্রহর ১২টা ১ মিনিটে প্রতিবছরের
ন্যায় এবারও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর
প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, আলোক শিখা প্রজ্বালন, আলোর মিছিল ও শপথ
গ্রহণের মাধ্যমে শোকের মাস আগস্টের মাসব্যাপী কর্মসূচী সূচনা করে।
শোকাবহ
পরিবেশে মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী
লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অজস্র সংগঠন। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও
শোকের মাসের প্রথমদিনে ধানম-িস্থ বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনের সামনে
স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচীর আয়োজন করেছে কৃষক লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা লন্ডনে থাকায় এবার এই কর্মসূচীতে প্রধান অতিথি হিসেবে কর্মসূচীর
উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
জাতীয় শোক
দিবস উপলক্ষে ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- ভোরে
বঙ্গবন্ধু ভবন এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা
অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ছয়টায় ধানম-ি ৩২ নম্বরে
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা
নিবেদন ও গার্ড অব অনার প্রদান, সাড়ে সাতটায় বনানী কবরস্থানে দোয়া,
মোনাজাত, ফতেহা পাঠ ও মিলাদ মাহফিল, দশটায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর
কবরস্থানে দোয়া ও ফাতেহা পাঠ, বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত,
সকল মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা, বাদ আছর অস্বচ্ছল দুস্থ মানুষদের মধ্যে খাবার
বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধু ভবনে মহিলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।
পরদিন
১৬ আগস্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের
আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে আওয়ামী লীগ
সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া আজ বুধবার থেকে মাসব্যাপী
আওয়ামী লীগের সকল সহযোগী, ভাতৃপ্রতীম ও সমমনা সংগঠনগুলো ধারাবাহিকভাবে
বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে জাতির পিতাকে স্মরণ করবে।
শোকাবহ আগস্টে
সমগ্র জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম ও
বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদা, শ্রদ্ধা,
ভালবাসা ও ভাবগম্ভীর আর বেদনাবিধুর পরিবেশে বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে
জাতীয় শোক দিবস পালন করবে।
তবে এবার জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচী সীমিত
পরিসরে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
ওবায়দুল কাদের
জানান, বাঙালী জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ, মর্মান্তিক হত্যার স্মৃতি
বিজড়িত আগস্ট মাস আমাদের দুয়ারে সমাগত। প্রতিবছর আগস্ট মাসে কেন্দ্র থেকে
তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচী পালন করা হয়। কিন্তু এবারও করোনার ভয়াবহতায়
লকডাউনের কারণে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে আগস্টের কর্মসূচী সীমিত
পরিসরে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
মাসব্যাপী
আগস্টের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মদিন উপলক্ষে সকাল
সাড়ে ৮টায় আবাহনী ক্লাব প্রাঙ্গণে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের
প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, সকাল সোয়া ৯টায় বনানী কবরস্থানে শ্রদ্ধা
নিবেদন। ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন উপলক্ষে সকাল
৯টায় বনানী কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে
সকাল সাড়ে ৮টয় ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল সোয়া ৯টায় বনানী কবরস্থানে
শ্রদ্ধা নিবেদন।
সকাল ১১টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের সমাধিতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলের শ্রদ্ধা নিবেদন।
এদিন জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দেশের সকল মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও প্যাগোডায়
বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও ১৬ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টায়
জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
পরেরদিন ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা
হামলা দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে
অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। ২১ আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে সকাল
৯টায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে
শ্রদ্ধা নিবেদন। বিকেল সাড়ে তিনটায় ঘরোয়াভাবে আলোচনা সভা। এছাড়াও ২৭ আগস্ট
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সকাল ৯টায় ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।