প্রভাষ আমিন ।।
আওয়ামী লীগের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বিবেচনা করলে ব্যারিস্টার সায়েদুর হক সুমন ‘হাইব্রিড’। আগে তেমন নাম শোনা না গেলেও গত কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎপরতার সুবাদে তারকা খ্যাতি পেয়েছিলেন আলোচিত এই ব্যারিস্টার। সেই আলোচনা তাকে টেনে নেয় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত। যুবলীগে হাইব্রিড হলেও ব্যারিস্টার সুমনকে অন্যদের কাতারে ফেলা যাবে না। তিনি তোষামোদি করে আলোচনায় আসেননি। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হওয়ার আগে-পরে তার বিরুদ্ধে কোনও ধান্দাবাজির অভিযোগ নেই। তিনি বরং আলোচনায় এসেছেন জনদুর্ভোগ তুলে ধরে, তাতে সরকারের সমালোচনাও ছিল। বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরতেন তিনি। নিজের এলাকায় বিভিন্ন জনহিতকর কাজও করেছেন। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটাও ছিল নিখাদ। তাই অন্য হাইব্রিডদের মতো তেলবাজি করে তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন, এমন অভিযোগ করা যাবে না। তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে কিনা, থাকলেও তা কতদূর; সেটা এখনও অজানা। তবে ব্যারিস্টার সুমনের যা কিছু অর্জন; তার তার নিজের। ব্যারিস্টার সুমনের মতো একজন সুশীল ঘরানার আইনজীবীকে দলে টেনে বরং যুবলীগ প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রশংসাটুকু ধরে রাখতে পারেনি যুবলীগ। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ব্যারিস্টার সুমনকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই তার উত্থান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই তার পতন। অবশ্য ‘পতন’ বিষয়টি আপেকি। পদলোভী হাইব্রিডদের বিবেচনায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পদ খোয়ানোটা পতন মনে হতেই পারে। তবে ন্যায্য অবস্থান নিয়ে ব্যারিস্টার সুমন পদ হারিয়েছেন মাথা উঁচু করেই।
৫ আগস্ট ছিল বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের জন্মদিন। এ উপলে শরীয়তপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ ৪ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টা এক মিনিটে মোমবাতি প্রজ্বালন ও পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দলীয় নেতাদের পাশাপাশি শরীয়তপুর সদরের পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেনও তাতে অংশ নেন। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে ওসি মোমবাতি হাতে স্লোগান দেন, ‘শুভ শুভ শুভদিন, শেখ কামালের জন্মদিন’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘আমরা সবাই মুজিব সেনা, ভয় করি না বুলেট বোমা।’ তার এই স্লোগান স্পষ্টতই সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন। তার এই স্লোগান পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ুণ্ন করেছে। তবে এটা হলো আদর্শ পরিস্থিতির ভাবনা।
বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা, তাতে সবাই নিজেদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রমাণে বেপরোয়া। অতীত ঘাঁটলে দেখা যাবে, ছাত্রদল বা শিবির করতেন; এখন বঙ্গবন্ধু বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। এই অতি উৎসাহীরা প্রশাসন আর পুলিশকে সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত করে ফেলছে। এই প্রবণতা অনেক দিনের। তবু একটা চুলজ্জা ছিল। কিন্তু আক্তার হোসেন লজ্জার সেই পর্দাটাও সরিয়ে দিলেন। তিনি যে ভুল করেছেন, অপরাধ করেছেন; সেই বোধটাও তার নেই। বরং তিনি এই অপরাধের সাফাই গাইতে দাবি করেছেন, ছাত্রজীবনে তিনি কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি বড় গলায় দাবি করেছেন, ‘আমি ছাত্রলীগ করতাম। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধে ও আবেগের কারণে স্লোগান দিয়েছি। এতে কোনও বিধি ভঙ্গ হয়েছে বলে মনে করছি না।’
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিশ্চয়ই এমন ‘দলীয় ওসি’ পেয়ে খুশি। কিন্তু একবার ভাবুন, পুলিশ আর প্রশাসনের সবাই যদি আক্তারের মতো আবেগের বশবর্তী হয়ে দলীয় স্লোগান ধরেন, তাহলে কী দাঁড়াবে অবস্থা?
দলীয় স্লোগান বিষয়টা নিয়েও একটু বিভ্রান্তি আছে। প্রথমে ‘দলীয় স্লোগান’ শুনে আমি ভেবেছিলাম, তিনি ‘জয়বাংলা’ বলেছেন। কিন্তু শুধু ‘জয়বাংলা’ বলাটা চাকরিবিধি লঙ্ঘন তো নয়ই, বরং না বলাটাই আদালত অবমাননা। আওয়ামী লীগ একে দলীয় স্লোগান বানিয়ে ফেললেও ‘জয়বাংলা’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণ স্লোগান। ওসি আক্তার ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিলে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু শুধু ‘জয়বাংলা’ বলে ান্ত থাকেননি। ‘শুভ শুভ শুভদিন, শেখ কামালের জন্মদিন’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘আমরা সবাই মুজিব সেনা, ভয় করি না বুলেট বোমা।’– স্পষ্টতই দলীয় স্লোগান।
যেকোনও রাজনৈতিক সরকারই চাইবে পুলিশ এবং প্রশাসন তাদের অনুগত থাকুক, তাদের কথা মেনে চলুক। কিন্তু সরকারি চাকরির তো কিছু বিধিমালা আছে। আর তারা তো সরকারের কর্মচারী, সরকারি দলের কর্মী নন। দল আর সরকারের পার্থক্যটা যত ঘুচে যাবে, ততই দেশের জন্য, দলের জন্য বিপদ। দল যদি সরকারে বিলীন হয়ে যায়, তাহলে সেই দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যারা আওয়ামী লীগ করেন, তারা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মেনে চলেন। তারা কী জানেন না, নাকি ভুলে গেছেন, বঙ্গবন্ধু দলকে সময় দেওয়ার জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন। সবাই ভুলে গেলেও শেখ হাসিনা কিন্তু ভোলেননি। গত ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার জন্মদিনে বিভিন্ন পত্রিকায় শেখ হাসিনার একটি লেখা ছাপা হয়েছে। মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখাটির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘এত কষ্ট তিনি (বেগম মুজিব) করেছেন জীবনে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেননি, চাননি। ’ ৫৪ সালের পরেও বারবার কিন্তু গ্রেফতার হতে হয়েছে। তারপর ’৫৫ সালে তিনি (বঙ্গবন্ধু) আবার মন্ত্রী হন, তিনি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচন করে জয়ী হন, মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। আমরা ১৫ নম্বর আবদুল গণি রোডে এসে উঠি। আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস দেখলে দেখবো সবাই মন্ত্রিত্বের জন্য দল ত্যাগ করে, আর আমি দেখেছি আমার বাবাকে যে তিনি সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য নিজের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলেন। ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন।’
এই হলো বঙ্গবন্ধুর শিা। কিন্তু তাঁর অনুসারীরা আজ দলকে সরকারে বিলীন করে দিতে ব্যাকুল। দেশে আজ আওয়ামী লীগের চেয়ে সরকারি দলের কর্মী বেশি। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলে যাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর ৫৫ সালের ইতিহাস ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু ৭৫-এর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য সরকারি কর্মচারীদের ব্যাকুলতার কথা এখন সবাই জানেন। বাকশাল গঠনের ছয় মাস পরই বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়িতে ৩২ ঘণ্টা পড়ে ছিল। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ সিঁড়িতে রেখেই আওয়ামী লীগের অনেকে বঙ্গভবনে ছুটে গেছেন মতার লোভে। তাই অতি উৎসাহী আক্তারদের দেখে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। ব্যারিস্টার সুমন দলের এই ভুলটাই ধরিয়ে দিয়েছিলেন ফেসবুকে। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগে কি স্লোগান দেওয়ার লোকের অভাব পড়েছে?’
সুমন চাকরিবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ওসি আক্তারের শাস্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু আক্তারের শাস্তি হয়নি। আমি নিশ্চিত আগামীতে আক্তারের ভালো পোস্টিং হবে, পদক পাবেন। আর যিনি দলের স্বার্থে ভুলটি ধরিয়ে দিলেন, সেই সুমনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলো। ব্যারিস্টার সুমন একজন ব্যক্তিমাত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাকে সেলিব্রেটি বানিয়েছে। একজন সুমন থাকা না থাকায় আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের কিছু যাবে আসবে না। তবে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মতো লোক দলে থাকা দরকার।
আওয়ামী লীগ প্রায় এক যুগ মতায় আছে বটে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো আর সারা জীবন মতায় থাকবে না। বিরোধী দলে গেলেও যাতে আওয়ামী লীগ টিকে থাকে তার জন্য দলকে শক্তিশালী করা দরকার। পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে সারা জীবন নির্বাচনে জেতা যাবে না। সংগঠন নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। ৭৫-এর পর অনেকেই ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ বুঝি বিলীন হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই তখন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তারপরও যে আওয়ামী লীগ টিকেছিল, ৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে যে হাল ধরার মতো নৌকা পেয়েছিলেন, তা দলের তৃণমূল কর্মীদের জন্য। শেখ হাসিনা সব সময় এই তৃণমূল কর্মীদের অবদান স্বীকার করেন। এই তৃণমূল হলো আওয়ামী লীগের বীজ। যত ঝড়-ঝাপটাই আসুক, এই বীজ থেকে আবার মহীরুহ হয়। তাই এই কর্মীদের টিকিয়ে রাখতে হবে। দল যাতে সরকারে বিলীন হয়ে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আগস্টের শোকের মাসে এটা যেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা ভুলে না যান।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ