লীনা পারভীন ||
১৯৭৫
সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো দিন। এই দিনেই এদেশীয় রাজাকার
বাহিনী দেশী বিদেশী শত্রুদের সাথে মিলে হত্যা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
বাঙালি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেদিন যদি শেখ
হাসিনা বিদেশে না থাকতেন তাহলে হয়তো তিনিও থাকতেন সেই তালিকায়।
১৯৮১
সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। বুকে নিয়ে ফিরেন এক আকাশ পরিমাণ
শোক ও কষ্ট। দেশ থেকে বিদেশে গিয়েছিলেন ঘরভর্তি মানুষ রেখে। পিতা মাতা ভাই
ভাইয়ের বৌদের সাথে হেসে খেলে বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আর দেশে ফিরলেন শূন্য
হাতে। যখন বিদেশের পথে যাত্রা করেছিলেন তখন কি তিনি কল্পনা করেছিলেন যে
ফিরে এসে দেখা হবে না তার প্রাণ প্রিয় বাবা মা’র সাথে? আদরের ছোট ভাই
রাসেলের কচি মুখে আর আপা ডাক শুনবেন না? আহ! স্বদেশ। কী নিষ্ঠুর সে ইতিহাস।
একটি দেশ যার জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর পিতা অথচ সেই দেশেরই কিছু নাগরিক ঝাঝরা
করে দিয়েছিলো তাঁকে। শেষ দেখাটাও দেখতে পাননি তিনি। পিতা মাতা ভাইদের মৃত
লাশগুলোও দেখা হয়নি আর। এ কষ্ট কাউকে বুঝানোর মত নয়। এ ব্যথা কোন মলমেই
মিইয়ে যাবার নয়।
তারপরও ফিরলেন তিনি। মাথা তুলে কেবল নিজেই দাঁড়ালেন না,
কেমন করে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় সেই শিাও দিলেন। জীবনের ঝুঁকি ছিলো। তিনি
ভয় পাননি। ভেঙে পড়েননি একবারের জন্যও। পিতার ফেলে যাওয়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে
যেতেই যেন সেদিন তিনি ফিরেছিলেন। কী দরকার ছিলো তাঁর ঝুঁকি নেয়ার? তিনিতো
জানতেন দেশে ফিরলেই তাঁর উপর নেমে আসবে হায়নার অত্যাচার। আরাম আয়েশের
বিদেশের জীবনে থেকে যেতে পারতেন অনায়াসেই। কিন্তু তিনি যে বঙ্গবন্ধু কন্যা।
সেই বঙ্গবন্ধু যিনি প্রশস্ত বুক নিয়ে জন্মেছিলেন কেবল এই বাংলাকে স্বাধীন
করার জন্য। সেই বঙ্গবন্ধু যিনি পাকিস্তানী সেনাদের সামনে বুক চিতিয়ে
মোকাবিলা করেছিলেন। মাথা নোয়াতে জানতেন না তিনি। হিংস্র পাকিস্তানী বাহিনী
যাকে আটকাতে পারেনি, টলাতে পারেনি নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে তাঁর কন্যা কি আর
ভয় পাবে? নিষেধাজ্ঞা স্বত্ত্বেও সাহস করে তিনি দেশের মাটিতে পা রাখলেন।
বারবার বলে চলেছেন তিনি দেশের জন্য ফিরেছেন। দেশকে বাঁচাতে প্রয়োজন হলে
জীবনও দিতে পারেন।
একবার ভেবে দেখেনতো যদি সেদিন শেখ হাসিনা ফিরে না
আসতেন তাহলে আজকের বাংলাদেশের চেহারা কী হতো? ৭৫ পরবর্তী সময়টাকে বিশ্লেষণ
করলেই পাওয়া যাবে সেই উত্তর। আজকের বাংলাদেশ হয়তো আরেকটি আফগানিস্তান হতে
পারতো। বি এন পি জামায়াত জোট সরকারের সময় বোমা হামলা যেন ছিলো একটি নিত্য
ঘটনা। মানুষের জীবন তাদের কাছে ছিলো খেলনার মত। সারাদেশে জঙ্গীদের উত্থান,
জায়গায় জায়গায় বোমা হামলার মত ঘটনাইতো তখন শিরোনাম ছিলো। হারিয়ে যেতে
বসেছিলো আমার সোনার বাংলার চিত্র।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে মানুষকে
গিলানোর চেষ্টা করা হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মত সংকীর্ণ এক বুলি।
সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ঘোলাটে হয়ে উঠছিলো দেশের আবহাওয়া। এমনি এক বৈরি
সময়ে উদ্ধারকর্তা হয়ে দেশের মাটিতে নামলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তাঁকেও
স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া হয়নি। রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাতে গিয়ে পেয়েছেন নানা
বাধা বিপত্তি। দলীয় প্রধান হিসেবে সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই তিনি
শুরু করেছিলেন সভা, মিছিল, মিটিং। গণতান্ত্রিক দেশেতো মিছিল মিটিং করা একটি
অধিকার। অথচ সেখানেও আসতে থাকলো আক্রমণ। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঝাল যে ভিতরে
জ্বালা করছিলো। একের পর এক হামলা চালাতে থাকলো শেখ হাসিনার উপর। মোট ২১ বার
হামলা করা হয়েছে ৮১ সালের পর থেকে। কিন্তু তিনি যে মৃত্যুঞ্জয়ী। এত সহজে
চাইলেই তাঁকে মেরে ফেলা যাবে না। বাংলার মানুষের ভালোবাসা তাঁকে বারবার
মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হামলা দেশ
হিসেবে বাংলাদেশের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দেয়। সেদিন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে
বি এন পি জামাত জোট সরকার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে মাঠে
নেমেছিলো একজন শেখ হাসিনাকে শেষ করে দিতে। অনেক দেশেই রাজনৈতিক
হত্যাকান্ডের ঘটনা আছে কিন্তু সরকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে কাউকে হত্যা করার ল্েয
কোন হামলা মনে হয়না আর কোন দেশেই আছে।
সেদিনের ঘটনাকে ছোট করে দেখার
কোন উপায় নেই। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে খুনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলো তারা।
রাষ্ট্র কখনও খুনী হতে পারেনা। কিন্তু সেইদিন খালেদা জিয়া, তারেক জিয়ারা
সেই জঘন্য কাজটিই করতে চেয়েছিলো। যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত ভয়ঙ্কর গ্রেনেড
হামলা চালিয়েছিলো তারা। আওয়ামীলীগের দলীয় বর্ম সেদিন বাঁচিয়ে দিয়েছিলো শেখ
হাসিনাকে। কোথায় পেয়েছিলো তারা সেইসব শক্তিশালী গ্রেনেড? কেন এনেছিলো?
সেদিনের
বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনার ভাগ্য নয় কেবল, এ আমাদের দেশের ভাগ্য। সেদিন যদি
তিনি ফিরে না আসতেন তাহলে আজকের বাংলাদেশ হতো না। সেদিন যদি আমরা
বঙ্গবন্ধুর মত শেখ হাসিনাকেও হারিয়ে ফেলতাম তাহলে বিশ্বের কাছে একটি খুনী
রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেতাম আমরা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এহেন ন্যাক্কার
উদাহরণ আর কোথাওনেই।
সফল হয়নি ঘাতকেরা। সফল হয়নি খালেদা, তারেকের
পরিকল্পনা। মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসলেন আমাদের শেখ হাসিনা। সেদিন তাঁকে যারা
উদ্ধার করেছিলেন তারা কেবল একজন ব্যক্তিকে উদ্ধার করেননি, উদ্ধার করেছিলেন
গোটা দেশকে, গোটা জাতিকে। একটি নতজানু হওয়া পরাস্থ জাতিকে মাথা তুলে দাঁড়
করার সাহস হয়ে ফিরে এসেছিলেন তিনি। ২১ আগস্ট সফল না হলেও প্রশ্ন রেখে গেছে
অনেক। কেন একটি নির্বাচিত সরকার সেই সময়ে রাষ্ট্রকে কাজে লাগিয়ে হত্যাকা-ের
মত ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়েছিলো? কোথা থেকে এসেছিলো সেইসব শক্তিশালী গ্রেনেড
বা অস্ত্র, গোলাবারুদ?
কাদের পরিকল্পনায় সেদিনের ঘটনা? এটা কি কেবল
দেশীয় ষড়যন্ত্র না এর পিছনে ছিলো বিদেশী কোন শক্তিও? এমন অনেক প্রশ্নকে
সামনে রেখেই সেদিনের ঘটনার আরও তদন্ত করতে হবে। ২১ আগস্টের ঘটনার বিচার
হয়েছে কিন্তু সেই বিচার সম্পূর্ণ বিচার নয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকা- যেমন একটি
স্বাধীন ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে করা উচিত ঠিক তেমনি ২১ আগস্টের ঘটনারও
বিস্তারিত তদন্ত হওয়া দরকার এবং সেটা দেশ ও জনগণের স্বার্থেই। আগামীর
বাংলাদেশকে নিরাপদ রাখতে হলে চিনাতে হবে সেইসব ষড়যন্ত্রকারীদের। তালিকা করে
মুখোশ উন্মোচন করতে হবে দেশী বিদেশী সকল কুচক্রীকে।
লেখক : কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।