কুমিল্লার শালবন বিহার...
তানভীর দিপু: লাল ইটের উপর গাঢ় সবুজের আস্তরণ- দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন ঐতিহাসিক স্থাপনার ছবি। বর্ষার প্রাকৃতিক অবগাহন শেষে কুমিল্লার কোটবাড়ির শালবন বিহারের রূপ এখন মোহিত করার মত। করোনার আগ্রাসণে দর্শণার্থীদের গা ঘেষাঘেষি করা ভিড় না থাকলেও যারাই আসছেন তাদের প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে ৮ম শতকে নির্মিত বৌদ্ধবিহার ভ্রমণ করে। এর পাশেই রয়েছে ময়নামতি যাদুঘর, শালবন বিহার ও আশের পাশের প্রত্নক্ষেত্র থেকে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ প্রত্নসম্পদ ময়নামতি জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
লকডাউনের দীর্ঘ সময় মানুষের পদচারণা না থাকায় শালবন বিহারের সবুজের সমারোহ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার পাশাপাশি দর্শণার্থীদের বেশি নজর কাড়ছে। সচরাচর এমন সৌন্দর্য্য থাকে না বলে জানান স্থানীয় এক দর্শণার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া জাকি উদ্দিন। তিনি জানান, শালবন বিহার খোলা থাকলে আমরা প্রায়ই এখানে ঘুরতে আসতাম। দীর্ঘদিন পর আসলাম, দেখে অবাক- সবুজ গাছপালা আর লাল ইটের দেয়ালগুলো যেন ধুঁয়েমুছে রেখেছে কেউ। অনন্য লাগছে।
শালবন বিহার ছাড়াও আশপাশের এলাকায় রয়েছে রূপবান মুড়া, কোটালিমুড়া, ইটাখলা মুড়া, আনন্দবিহার, ভোজবিহার, ময়নামতির রানির বাংলো। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্র জানায়, শালবন বৌদ্ধবিহারের আয়তন ৩৭ একর। প্রত্নসম্পদে সমৃদ্ধ স্থানটি আগে শালবন রাজার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু সেখানে ১৯৫৫ সালে খননের পর ৫৫০ ফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত একটি বৌদ্ধবিহারের ভূমি নকশা উন্মোচিত হয়। এতে ১১৫টি ভিক্ষুকক্ষ রয়েছে। লালমাই পাহাড় এলাকায় বিহারটির আশপাশে একসময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল। তাই বিহারটির নাম দেওয়া হয় শালবন বিহার।
শালবন বিহার ও ময়নামতি যাদুঘরের কস্টোডিয়ান মোঃ হাসিবুল সুমি জানান, চলতি বছরের এপ্রিলের শুরু থেকে লকডাউনের কারণে জনমানবশূণ্য হয় এই প্রাচীণ জনপেদের সাক্ষর বিহারগুলো। লকডাউন শেষে ১৯ আগষ্ট আবার খুলে দেয়ার পর বিহার ও যাদুঘরে আসতে শুরু করেছে দর্শণার্থীরা। গত ১৫ দিনে শালবন বিহার ও ময়নামতি যাদুঘরে প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। এছাড়া রূপবান মূড়ায় প্রতিদিন গড়ে ৫ শ টাকা ও ইটাখোলামূড়ায় ২ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যংটন মৌসুমে করোনার প্রকোপ না থাকলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রচুর দর্শণার্থী ভিড় জমাবেন বলে আশা করছি।
শালবন বিহারের মধ্যভাগে একটি মন্দির ও উত্তর বাহুর মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে নান্দনিক ও কারুকার্যময় প্রবেশ তোরণ। খননে প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির নিদর্শন থেকে জানা যায়, দেব বংশের চতুর্থ রাজা শ্রী ভবদেব খ্রিষ্টীয় আট শতকে এ বিহার নির্মাণ করেন। তখন বিহারটির নাম ছিল ভবদেব মহাবিহার।
প্রত্নসম্পদে ভরপুর কোটবাড়ী এলাকার শালবন বৌদ্ধবিহারের প্রথম খননকাজ ১৯৫৫ সালে শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত খনন করে শালবন বৌদ্ধবিহারের মূল মন্দিরকে ঘিরে চার পাশে ছোট ছোট নয়টি মন্দির ও ছয়টি স্তূপ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মূল মন্দিরের বাইরে আরও দুটি মন্দির ও চারটি স্তূপ আবিষ্কৃত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ নভেম্বর থেকে মূল বৌদ্ধবিহারের (মন্দিরের) উত্তর-পূর্ব কোণে পাঁচ বর্গমিটার আয়তনের ২১টি বর্গাকৃতি স্থানে খননকাজ শুরু করা হয়। গত ৩০ নভেম্বর সেখানকার একটি স্থানে ইট ও কাদামাটির তৈরি কূপের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন গোলাকার কূপটির ব্যাসার্ধ ১১ ফুট চার ইঞ্চি।