জাহেদ-উর-রহমান ||
অনলাইন
কেনাকাটায় সবার প্রিয়, মাশরাফির আস্থা ই-অরেঞ্জ- এ কথাগুলোর সঙ্গে কমলা
রঙের টি-শার্ট পরে মাশরাফির ছবি দিয়ে ই-অরেঞ্জের একটি বিজ্ঞাপন দেখতে
পেলাম। বিজ্ঞাপন খুঁজতে গেলাম কারণ ই-অরেঞ্জের প্রতারিত কিছু গ্রাহক কয়েক
দিন আগে তার বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। গ্রাহকদের একটা বড় অংশ এখন
আবার বলছেন, তারা তার বাড়ি ঘেরাও করবেন।
স¤প্রতি এই প্রতিষ্ঠানটি ছাড়াও
ইভ্যালি, আলেশা মার্ট ইত্যাদি নামে অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের
অকল্পনীয়, বাস্তবায়ন অযোগ্য সব প্রতিশ্রæতি দিয়ে তাদের কাছ থেকে বিপুল
অঙ্কের অগ্রিম অর্থ নিয়েছে। একটা পর্যায়ে এসে প্রতিশ্রæত পণ্য সরবরাহ তো
করেইনি, মানুষের কাছ থেকে গৃহীত অর্থ ফেরতও দেয়নি।
ধরে নেওয়া যাক আলোচিত
এই ই-কমার্স সাইটগুলো তাদের মালিকদের ভাষ্যমতো ব্যবসা শুরুর দিকে
ভোক্তাদের মনোযোগ দ্রæত আকর্ষণের জন্য কিছুদিন এই রকম অবিশ্বাস্য অফার
করেছে। এই খাতে তারা কয়েকশ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তারপর তারা ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি কমিয়ে একটা সাধারণ ই-কমার্স সাইটে পরিণত হবে
এবং এটাও মনে করে নেওয়া যাক ক্রেতাদের পণ্য প্রাপ্তিতে কিংবা পণ্য না পেলে
টাকা ফেরত পাওয়াতে কোনো রকম সমস্যা হচ্ছে না। মজার ব্যাপার, এই ইউটোপিয়ান
পরিস্থিতিতেও এটা একেবারেই বেআইনি, এটা কোনোভাবেই চলতে দেওয়ার কথা ছিল না।
পশ্চিমের এন্টিট্রাস্ট ল' এর আদলে বাংলাদেশেও আইন আছে প্রতিযোগিতা
আইন-২০১২। আইনের নামটি নিশ্চয়ই স্পষ্ট করে। এই আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারে
সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। এই আইনে একটি প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করার
কথা এবং সেটা বাংলাদেশে আছে। আইনে সেই কমিশনের কার্যাবলির প্রথম কথাটি
হচ্ছে এটা- ৮.১(ক) বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী
অনুশীলনসমূহকে নির্মূল করা, প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা ও বজায় রাখা এবং
ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা।
হঠাৎ মানুষের টাকা মেরে না
দিলেও শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বাজারে এমন একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা
ই-অরেঞ্জ, ইভ্যালি এবং অন্য ই-কমার্স সাইটগুলো কোনোভাবেই তৈরি করতে পারে
না। এমন অফার শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই কথা ছিল প্রতিযোগিতা কমিশন সেটিকে বন্ধ
করবে। মাশরাফির বাসার সামনে অবস্থান এবং ভবিষ্যতে তার বাসা ঘেরাও করার
পেছনে ই-অরেঞ্জের প্রতারিত গ্রাহকদের প্রধান যুক্তি হলো, তারা তাকে দেখেই
সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাশরাফি
জানিয়েছিলেন, দোষারোপ করার আগে জানতে হবে আমি শেয়ারহোল্ডার কিনা? আপনি যখন
মালিকানায় না থাকবেন, তখন কী-ই বা করতে পারবেন। আমি চেষ্টা করেছি তাদের
সহযোগিতা করার, তবে তাদের সঙ্গে আমার চুক্তি এক-দেড় মাস আগে শেষ হয়ে গেছে।
দেশের
প্রশাসন এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সামনে যখন কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়মকানুন
না মেনে প্রকাশ্যভাবে ব্যবসা করে এবং তাদের ব্যবসার ধরন সম্পর্কে কোনো
প্রশ্ন তোলা না হয়, তখন যে কোনো সেলিব্রেটি ভাবতেই পারেন সেই ব্যবসাটা সঠিক
আছে। তখন সেসব প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হওয়া কিংবা বিজ্ঞাপনে
অংশগ্রহণ করা কোনো সেলিব্রেটির কাছে সঠিক মনে হতেই পারে। একটা পণ্যের
অ্যান্ডোর্সার হতে পারা একজন সেলিব্রেটিকে প্রতিটি দেশের মানদÐে বিশাল
অঙ্কের অর্থ জোগান দেয়। সে কারণেই সেলিব্রেটিদের তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে
সচেতন থাকা জরুরি। ইউরোপ বা আমেরিকা তো বটেই, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ
ভারতেও এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর থেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। ২০১৫
সালে অমিতাভ বচ্চন, মাধুরী দীক্ষিতসহ আরও কয়েকজন তারকার বিরুদ্ধে এজাহার
দায়ের করা হয়েছিল। কারণ তারা ম্যাগি নুডলসে উচ্চমাত্রায় ক্ষতিকর মনোসোডিয়াম
গ্লুটামেট (টেস্টিং সল্ট) থাকার পরও সেই কোম্পানির বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছেন।
যুক্তি হচ্ছে, তাদের কারণেই অনেক বেশি মানুষ এই পণ্যটি কিনেছে এবং ক্ষতির
শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালেই আবার একটি হাউজিং কোম্পানি থেকে ফ্ল্যাট কেনা
গ্রাহকরা মহেন্দ্র সিং ধোনির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। কারণ ধোনি সেই
কোম্পানির বিজ্ঞাপনে যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছিলেন, বাস্তবে তারা
সেগুলোর সব পাননি। তাদেরও দাবি, ধোনিকে সেই বিজ্ঞাপনে দেখেই সে কোম্পানির
প্রতি আস্থা রেখেছিলেন তারা।
ভারতে এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে এবং প্রতিটি
ঘটনার পর নানা দিক থেকে তর্কবিতর্ক হয়েছে সেখানে। শেষ পর্যন্ত ভারতে এই
সিদ্ধান্ত এসেছিল, পণ্যের অ্যান্ডোর্সারদের (পণ্যদূত) এই ব্যাপারগুলো খেয়াল
রাখতে হবে এবং বিষয়টি আইনি কাঠামোর অন্তর্ভুক্তও করা হয়। ১৯৮৬ সালে প্রণীত
ভারতের কনজ্যুমার প্রটেকশন অ্যাক্ট অনেক পরিবর্তনসহ নতুন করে করা হয়েছে
২০২০ সালে। সেখানে যে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেআইনি কাজ করলে তার
পণ্যদূতদেরও শাস্তির বিধান রাখা আছে। ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং
কমপক্ষে এক বছর আর কোনো ব্যবসার পণ্যদূত হওয়া থেকে বিরত রাখার আইনি বিধান
করা হয়। সমাজের একজন সেলিব্রেটিকে তার যশ, খ্যাতি, অর্থ- সবকিছুর সঙ্গে
সমানুপাতিক হারে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিটা পদক্ষেপ দেওয়ার আগে তাদের খুব
গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে তাদের সেই পদক্ষেপের প্রভাব সমাজের
মানুষের ওপর কীভাবে পড়ে। কোনো আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি না হতে হলেও তাদের
নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকতেই হবে।
লেখক:শিক্ষক ও নাগরিক অধিকারকর্মী