ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
সংসদে সব হাস্যরসই হাসির নয়
Published : Monday, 6 September, 2021 at 12:00 AM
সংসদে সব হাস্যরসই হাসির নয়মোস্তফা হোসেইন ||
সংসদের ভাষণ-বক্তৃতা মাঝে মধ্যে সংসদের বাইরেও বিনোদনের খোরাক জোগায়। কখনও তা হাস্যরসে ভরপুর থাকে, কখনও সংসদ সদস্যদের নিয়েও প্রশ্নের জন্ম দেয়। রসাত্মক বক্তৃতা-বক্তব্যগুলো সবাই রসের সঙ্গে গ্রহণ করলেও কিছু বক্তব্য নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনার গভীরতা নিয়েও ভাবিয়ে তোলে। তেমনই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে চলতি অধিবেশনে বগুড়া-৭ থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলুর দেওয়া বক্তৃতা। কেউ কেউ মনে করছেন, অগ্রসরমান বাংলাদেশকে পেছনে ঠেলার প্রস্তাবনাই নয়, এই বক্তব্য আসলে তার চিন্তাশক্তি নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে।
তিনি বলেছেন, এই সংসদে যেন এমন একটি আইন করা হয়, যাতে চাকরিজীবী ছেলে কিংবা মেয়ে যেন অপর চাকরিজীবী মেয়ে কিংবা ছেলেকে বিয়ে করতে না পারে। অর্থাৎ ছেলে ও মেয়ে উভয়েই চাকরিজীবী হলে তাদের বিয়ে বন্ধ করতে হবে। তিনি তার এই প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, এতে বেকারত্ব কমবে এবং গৃহকর্মীদের দ্বারা শিশু নির্যাতন বন্ধ হবে।
বগুড়া থেকে নির্বাচিত এই  স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের বক্তৃতার পর সঙ্গত কারণেই মনে হতে পারে, তিনি কি আসলে বুঝে-শুনে এই প্রস্তাব রেখেছেন, নাকি সংসদে হাস্যরস তৈরির জন্য এমন বক্তব্য দিয়েছেন। বোধগম্য নয়, বেকার তৈরি করার মাধ্যমে কীভাবে বেকার সমস্যার সমাধান হবে।
তার বক্তব্য প্রদানকালে তিনি নিজে ছিলেন সিরিয়াস। যদিও অন্য সংসদ সদস্যগণ সমবেতভাবেই হাস্যরোলে তার বক্তব্যের প্রাথমিক জবাব দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রীকে জবাব দিতে হয়েছে, সংসদ সদস্যের বক্তব্যের পর। তিনি কিন্তু হাস্যরসের আশ্রয় নেননি। বলে দিয়েছেন, এমন অসাংবিধানিক কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর বাকস্বাধীনতার সুযোগে মাননীয় সংসদ সদস্য যা মনে আসে তা বলতে পারলেও গণপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি এমন জনবিরোধী উদ্যোগ নিতে পারেন না। ফলে সংসদ সদস্য বাবলুর বক্তৃতার রেশ ধরে আর হাস্যরসের স্থায়িত্ব হয়নি।
তবে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য দিয়ে প্রস্তাব বিষয়ে আপাতত আলোচনার সমাপ্তি ঘটলেও আমাদের সংসদ সদস্যদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে দিলো। হয়তো অন্য কোনও সংসদে কিংবা অন্য কোনও আইনমন্ত্রী জবাবদানকালে হাস্যরস দিয়ে বিষয়টিকে হালকা করে দিতেন। কিন্তু বর্তমান আইনমন্ত্রী মেপে কথা বলার লোক হওয়ার কারণে হয়তো মেপে মেপেই জবাব দিয়েছেন সংসদে দাঁড়িয়ে।
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি, জাতীয় সংসদে শুধু আইনের কাঠকোট্টা আলোচনাই হয় না। কখনও কখনও সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সদস্যদের রসালো বক্তব্যে। তবে সেখানেও সংসদ সংশ্লিষ্টতা থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আইনগত বিষয়গুলোর পাশাপাশি সেসব আলোচনাও মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। শালীনতা বজায় রেখে ব্যক্তিগত বিষয়ও অনেক সময় আলোচনায় চলে আসে। যা নিয়ে হাস্যরসের আবহ তৈরি হয়। অংশগ্রহণকারীদের মতো দর্শক এবং সংবাদে প্রকাশ হওয়ার পর দর্শক/পাঠকও মজা থেকে বঞ্চিত হন না।
বোধ করি সা¤প্রতিক সংসদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বক্তব্য ছিল প্রয়াত সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তের। তার আগে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও সংসদে হাসাহাসির পরিবেশ তৈরি করতে পারতেন। তবে তার বক্তব্যগুলোর মধ্যে অধিকাংশই থাকতো আক্রমণাত্মক। তারও আগে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বক্তব্যও সংসদে ভিন্নরকম হাসির পরিবেশ তৈরি হতো। ব্যক্তিগত হওয়ার পরও অসংসদীয় অভিধায় অভিষিক্ত করা যেত না এমন বক্তব্য বোধহয় সবচেয়ে বেশি দিতেন সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত।  তাঁর রসাত্মক বক্তব্যগুলোতেও মেসেজ থাকতো কোনও না কোনও। এই মুহূর্তে দশম সংসদে তাকে নিয়ে ও তাঁর বক্তব্যের কথা মনে আসছে।
তিনি একবার সংসদ অধিবেশনে এসেছিলেন  লাল পাঞ্জাবি পরে। স্পিকারের দৃষ্টিতে পড়ে বিষয়টি। স্পিকার রসিকতা করতে ভুল করলেন না। বললেন, মাননীয় সদস্য, আপনার রঙিন পাঞ্জাবিটি মানিয়েছে বেশ। সুন্দর লাগছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক সদস্য টেবিল চাপড়ে স্পিকারের কথার প্রতি সমর্থন জানান। সংসদে তৈরি হাস্যরসের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, “মাননীয় স্পিকার, মানুষের জীবনের রঙ যখন হারিয়ে যায়, তখন অন্যান্য রঙ দিয়ে নিজেকে রাঙাতে চায়। আমিও অনেকটা সেই চেষ্টাই করেছি, মাননীয় স্পিকার।”
আবার মনের অজান্তে অমিল শব্দচয়নের কারণেও অনেক সময় হাসির সুযোগ পান সংসদ সদস্যগণ। দশম সংসদেরই আরেকটি ঘটনার কথা বলা যায়। তখন প্যানেল স্পিকার হিসেবে সংসদ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন আবুল কালাম আজাদ। জয়পুরহাট থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য বক্তৃতায় বলেন ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা পুকুর। ” এই বক্তব্যের পর সংসদে হাসির রোল পড়লে ওই সংসদ সদস্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে বক্তব্য সংশোধন করেন। গোয়ালে ধানের কব্জায় পড়েন  দশম সংসদেরই আরেক সদস্য  ভোলা-৩ আসনের  নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। তিনি তাঁর বক্তৃতায়  বলেন,‘গোয়াল ভরা ধান’ এবারও সদস্যরা হেসে ওঠেন। কিন্তু শাওন তার ভুল বুঝতে না পেরে বক্তব্য চালিয়ে যান।
সংসদ সদস্যের সারি থেকে স্পিকারের চেয়ারে বসার পরও নিজের অভ্যাসকে পাল্টাতে না পারার উদাহরণও আছে। ওই সময়ই একজন প্যানেল স্পিকার সংসদ সদস্যদের মাননীয় স্পিকার সম্বোধন করে হাস্যরসের জোগান দেন।
এমন বক্তব্যগুলো কোনোটাই সদস্যদের বিষয়ে প্রশ্ন জন্ম দেয় না। সংসদ সদস্যগণ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ বেশ উপভোগ করেন। এমনকি সরকারি দল বিরোধী দল সবাইকে একসঙ্গে অন্তত হাসার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু বগুড়ার বাবলু সাহেব যে প্রস্তাবটি করেছেন, তা কিন্তু ভেবেচিন্তে করেছেন। প্রশ্ন এখানেই। আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আইনমন্ত্রী যেমন বলেছেন, বলার স্বাধীনতা আছে বলে যা মনে আসে তাই বলতে পারেন সেটাই কি সত্য? একইসঙ্গে জানার ইচ্ছা জাগে, সংসদের সময় সম্পর্কে কিংবা সংসদ সম্পর্কে মাননীয় সংসদ সদস্য কতটা সচেতন।
মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতোই মনে হতে পারে তার এই বক্তব্য। অনুমান করতে পারি, তিনি হয়তো এমন কোনও দম্পতিকে দেখেছেন, স্বামী-স্ত্রী দু'জনই চাকরি করার কারণে ওই পরিবারের শিশুর পরিচর্যায় সংকট তৈরি হয়েছে। তেমন হলে এটা নিশ্চয়ই সমাধান হতে পারে না। তিনি যদি কর্মজীবী পরিবারগুলোর সমস্যা সমাধান সম্পর্কে কোনও আইন করার প্রস্তাব করতেন তাহলে হয়তো এ নিয়ে নিবন্ধ লেখারও প্রয়োজন হতো না। তিনি বলতে পারতেন কর্মজীবী নারীর সন্তান যাতে নিরাপদে থাকতে পারে সে জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার কর্মসূচি দ্রæত বাস্তবায়ন করতে হবে। কিংবা বিকল্প কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলতে পারতেন। তিনি সেই  পথে না গিয়ে সংসদ সদস্যদের চিন্তা-ভাবনার গভীরতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। বাংলাদেশের আইন পরিষদে জনকল্যাণমূলক সময় ব্যয় হবে, মাননীয় সংসদ সদস্যগণ সেখানে সাধারণ মানুষের কথা বলবেন, আর তা অবশ্যই যেন হয় প্রশংসা পাওয়ার মতো। এমন প্রত্যাশা তো আমরা করতেই পারি।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।