ড. কবিরুল বাশার ||
করোনা
অতিমারির মধ্যেই আরেকটি স্বাস্থ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গড়ে ভর্তি হচ্ছে আড়াই শ মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে গত ১
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে ২৫০ জন। ঢাকার ৪১টি সরকারি ও
বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে সর্বমোট ভর্তি রোগী আছে এক হাজার ১৫ জন এবং
অন্যান্য বিভাগে ভর্তি আছে ১৪১ জন। এই বছর ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ হাজার
৬৫১ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৪৫ জন মারা গেছে।
ঢাকার ৪১টি হাসপাতাল ছাড়াও অন্যান্য হাসপাতালে ও বাসায় রোগী আছে এর প্রায়
তিন গুণ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী শুধু আগস্ট মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে
হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে প্রায় সাত হাজার ৬৯৮ জন এবং মারা গেছে ৩৩ জন।
ডেঙ্গু
পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে এটির সতর্কবার্তা আমরা জুনের শুরুতে দিয়েছি।
আমার দলের গবেষণার ফল অনুযায়ী ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব এখনো ডেঙ্গু ছড়ানোর
উপযোগী মাত্রায় রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসেও ডেঙ্গু আক্রান্তের হার খুব কমে
আসবে বলে আমাদের গবেষণা মডেল বলছে না।
করোনার মতো ডেঙ্গু অদৃশ্য শক্তি
নয়। মোকাবেলা করা খুব কঠিন নয়। ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে আর এটিকে
নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস
মশা নিয়ন্ত্রণও সহজ, কারণ এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে বংশ বিস্তার করে। জমা
পানির পাত্র অপসারণ কঠিন কোনো কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের
পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশা
কীটনাশক সহনশীল, তাই কীটনাশক দিয়ে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়।
বাংলাদেশের
ইতিহাসে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল এবং মারা
গিয়েছিল। সে বছরই এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি
পরিকল্পনা দেওয়া হয়। বর্তমান সংকট মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি।
জরুরি পদক্ষেপ : যেসব এলাকা
ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে গেছে অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি, সেসব এলাকায়
জরুরি ভিত্তিতে অন্য ওয়ার্ড থেকে ফকিং মেশিন সরবরাহ করে ক্রাশ প্রগ্রামের
মাধ্যমে উড়ন্ত মশা মারার অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অন্য ওয়ার্ডগুলোর
ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি বøকে ভাগ করে
১০টি টিম গঠন করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা
প্রয়োজন। এই ১০টি টিমের প্রতিটিতে স্থানীয় তরুণ সমাজসেবকদের দায়িত্ব দিয়ে
তাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের মশক নিধনকর্মীদের যুক্ত করে দিয়ে এডিস মশার
প্রজনন পাত্র ধ্বংস ও অপসারণের পাশাপাশি উড়ন্ত মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক
ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি টিমকে নিশ্চিত করতে হবে যেন তার বøকে কোনো এডিস
মশা জন্মানোর পাত্র না থাকে। প্রতিটি বøকের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মনিটরিং ও
ইভালুয়েশনের জন্য সিটি করপোরেশনের সেন্ট্রাল টিম থাকতে পারে। যে বøকে
ডেঙ্গু রোগী সবচেয়ে কম হবে, তাদের পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে কাজে উৎসাহিত করা
যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা : অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করে ডেঙ্গু
নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে ৫ থেকে ১০ বছর মেয়াদি
মহাপরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সারা
বছর চলমান থাকতে হবে।
সংকটময় পরিস্থিতিতে কাউকে দোষারোপ না করে যার যার
কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের
দায়িত্ব রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থান, সরকারি স্থাপনা, বাস টার্মিনালগুলোতে
এডিস মশার প্রজনন বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা। আর নগরবাসীর দায়িত্ব তার বাড়ি ও
আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয় তা নিশ্চিত করা। সিটি করপোরেশন ও
নগরবাসীর সম্মিলিত কার্যক্রমই পারে ডেঙ্গু সমস্যার সমাধান করতে।
লেখক : কীটতত্ত¡বিদ, গবেষক, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়