ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আমার শহর ‘কুমিল্লা’
Published : Tuesday, 7 September, 2021 at 12:00 AM
আমার শহর ‘কুমিল্লা’শন্তিরঞ্জন ভৌমিক ।।
পর্ব-১০
এক সময় কুমিল্লা শহরটি ছিল ত্রিপুরার অন্তর্গত। পরে পাকিস্তানের এবং এখন স্বাধীন বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ জেলা। এ জেলাকে বিংশশতাব্দীর আশির দশকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য তিনভাগে বিভক্ত করে তিনটি জেলায় রূপান্তরিত করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-চাঁদপুর স্বতস্ত্র মহকুমা ছিল বলে জেলা হয়ে যায়, কিন্তু কুমিল্লায় ছিল দুটি মহকুমা- কুমিল্লা উত্তর ও কুমিল্লা দক্ষিণ। কিন্তু এ দুটি মহকুমাকে পৃথক দুটি জেলা করা হয়নি। ফলে বর্তমান কুমিল্লা জেলাটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর জেলায় পরিগণিত হয়েছে, এ জেলায় রয়েছে ১৭টি উপজেলা। প্রতিটি উপজেলায় একজন করে উপজেলা চেয়ারম্যান, একজন করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং একজন করে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাসহ স্বাতন্ত্রিক প্রশাসন।
    অনেক আগ থেকে কুমিল্লাবাসীর দাবি ছিল এবং আছে কুমিল্লা একটি পৃথক বিভাগ হোক। বিভাগ হতে হলে অন্তত চারটি জেলার সমন্বয়ে হতে হয়। সেজন্য কুমিল্লা বিভাগের জন্য ফেনী-নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরের সংযুক্তির জন্য দেনদরবার করতে হচ্ছে। একসময় বৃহত্তর নোয়াখালীর পক্ষে আপত্তি না থাকলেও এখন শোনা যায়, তারাও স্বাতন্ত্রিকভাবে বিভাগ দাবি করছেন। তা তারা করতেই পারেন। যদি কুমিল্লা উত্তর ও কুমিল্লা দক্ষিণ মহকুমা দুটি পৃথক জেলা হয়ে যেত, তবে হয়ত অপেক্ষা করতে হতো না। এখন সেজন্য একটি নতুন জেলা ঘোষণার আগে বিভাগ ব্যাপারটি ঝুলে আছে। এছাড়া বিভাগটির নামকরণ নিয়েও এক ধরনের মিশ্র প্রতিযোগিতার কথা শোনা যায়। রংপুর-বরিশাল-সিলেট-ময়মনসিংহ বিভাগ হওয়ার আগেই কুমিল্লা বিভাগ হওয়ার কথা ছিল, আয়োজন ছিল- কোথায় যেন সমন্বয়হীনতা। আশা করি এক সময় ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা অবশ্যই বিভাগ হবে। এ প্রত্যাশা কোনো স্বপ্নবিলাস নয়, যৌক্তিক দাবি। এজন্য রাজনৈতিকভাবে যাঁরা কুমিল্লাকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বিভাগ প্রশ্নে তাঁদেরকে অবশ্যই এক মঞ্চে সমবেত হতে হবে। ব্যক্তিবিশেষের কৃতিত্ব হিসেবে আত্মশ্লাঘা যাপন করার সুযোগ নেই। অবশ্যই বৃহত্তর স্বার্থে মানসিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এখন প্রশ্ন-বিভাগ হলে লাভ কী হবে। এ হিসাবটা করা দরকার। বর্তমানে জনপ্রতিনিধিত্ব চারটি প্রতিষ্ঠান আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় আছে।
১.    কুমিল্লা-৬ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচিত মাননীয় সংসদ সদস্য।
২.    জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তাঁর কর্মপরিধি সিটি কর্পোরেশনের বাইরে সমগ্র জেলাব্যাপী।
৩.    উপজেলা চেয়ারম্যান। তাঁর কর্মপরিধি সিটি কর্পোরেশনের বাইরে উপজেলা কেন্দ্রিক। এবং
৪.    সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। তাঁর আছে ২৭টি ওয়ার্ড।

এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১নং প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ মাননীয় সংসদ সদস্য হলেন অভিভাবক এবং প্রধান সমন্বয়কারী। তাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতা ছাড়া বাকী তিনটি প্রতিষ্ঠান কোনো কাজ স্বাধীনভাবে করতে পারেন না। এটা সরকারি বিধিমালার প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ আছে।

জেলা পরিষদের সকল কাজের জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি বাধ্যতামূলক। সতেরটি উপজেলার এগারটি নির্বাচনী এলাকা রয়েছে, এজন্য কুমিল্লা জেলায় এগার জন মাননীয় সংসদ সদস্য। জেলা পরিষদ যখন যে নির্বাচনী এলাকায় তার কর্মকাণ্ড চালাবেন, তাঁকে অবশ্যই সে নির্বাচনী এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্যের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিতে হবে।
উপজেলা প্রশাসনে চেয়ারম্যান নির্বাচনী এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশ মতোই চলতে হয়। এছাড়া নির্বাচনী এলাকায় যদি ইউনিয়ন পরিষদ থাকে, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণও স্থানীয় সংসদ সদস্যের পরামর্শ, সহযোগিতা ও অনুমতিক্রমেই তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন।
সবকিছুতেই একটা চেইন অব (শৃঙ্খলা) ডিসিপ্লেইন রয়েছে। চমৎকার বোঝাপড়ার মধ্যে এই কর্মধারা চলমান থাকলে স্ব স্ব এলাকার জনগণ অবশ্যই সেবা পাবে, দেশ এগিয়ে যাবে।
লক্ষণীয়, মাননীয় সংসদ সদস্য দেনদরবার করে সরকার থেকে তাঁর এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে অর্থ বরাদ্ধ মুঞ্জুর করিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগান দেন। সে অর্থ বিধি মোতাবেক সে সব প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থে খরচ করেন। এ’ক্ষেত্রে মাননীয় সংসদ সদস্যের পরামর্শ ও সহযোগিতা ছাড়া অর্থব্যয়ে তাঁর কোনো ভূমিকা থাকে না বলেই জানি। কাজেই জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদ যদি স্বচ্ছ ভূমিকা না রাখতে পারে, তাহলে জনদুর্ভোগের বিষয়টি হয়ে পড়ে মারাত্মক, বিধ্বংসী। এ প্রেক্ষিতে কিছু কথা।
আমার শহর ‘কুমিল্লা’ অনেকদিন পৌরসভার অধীনে ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে এসেছে। মাত্র ৭/৮ বছর আগে এ পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করা হয়। পৌরসভার অধিবাসী হিসেবে নিজেদেরকে শহরবাসী বলতাম, এখন সিটি কর্পোরেশনের ফলে গালভরা পরিচয় দিচ্ছি ‘নগরবাসী’ হিসেবে। নামের বাহার তো হলো, কিন্তু পরিবর্তন বা সুযোগ সুবিধা কি হলো?
পরিচিত তরকারি ‘লাউ’, কোনো কোনো এলাকায় বলে ‘কদু’। অন্য নামও থাকতে পারে। কিন্তু আকৃতি-স্বাদ-রং প্রায় এরূপ। শরীরের যে অঙ্গটিকে ঠেং বলি, তাকেই পা বলি, আবার চরণও বলি। আমার শহর ‘কুমিল্লা’ তখনকার পৌরসভা এবং এখনকার সিটি কর্পোরেশন- লাউ থেকে কদু অথবা ঠেং থেকে পা অথবা চরণ-শুধুই নামের বাহার ছাড়া দৃশ্যত বা অন্তর্গত কোনো পার্থক্য দৃশ্যমান হয় না। সিটি কর্পোরেশন হওয়াতে হোল্ডিং টেক্স বা কর, জলের কর ইত্যাদি শতগুণ বেড়ে গেছে, বাড়িঘর করতে গেলে নকসাপাশের খরচ বৈধ কর বেড়েছে, অবৈধ করের কোনো হিসাব নেই। পৌরসভা থাকতে শহরবাসী বর্ষাকালে হেঁটে-রিক্সায়-গাড়িতে চলাচলে কোনো অবস্থায় জলাবদ্ধতায় বাধাগ্রস্ত হতো না। সিটি কর্পোরেশন হওয়ায় বর্ষাকালে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বোর্ড এলাকায় বাসস্থান থেকে নৌকায় অফিসে আসতে হয়। পার্কের পূর্বাংশে তেমাথায় সখ করে মেয়র নিজের প্রতিকৃতি টাইলস দিয়ে রাস্তায় বসিয়ে রেখেছেন, তিনিও বর্ষায় বৃষ্টির জলে ডুবে গেলেন। এক অশনি সংকেত। সামান্য বৃষ্টি হলে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এলাকা ভেনাস নগরী হয়ে যায়। নির্বাচিত মেয়র অনেক যুক্তি উপস্থাপন করেন, কিন্তু নগরবাসীকে মূর্খ ভাবেন হয়ত, তাঁদেরকে যা বলা হবে, তা-ই মেনে নিবে-এ সময়ে এরূপ বোকা হয়ত কেউ নয়। বিষয়টা লেজেগোবরে মিলেমিশে গেছে। এক্ষেত্রে নগরের জন্য জেলাপরিষদ বা উপজেলা পরিষদের কোনো দায় বা ভূমিকা নেই। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের দায়, জবাবদিহিতা এবং যোগ্যতার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে অভিভাবকের ভূমিকা। বিশেষত মাননীয় সংসদ সদস্যের পরামর্শ ও সহযোগিতা।
আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় রাজনৈতিক মতাদর্শে মাননীয় সংসদ সদস্য ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র দু’মেরুতে অবস্থান করছেন। তারপরও আমরা নগরবাসী জানি- রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা থাকলেও শহর কুমিল্লার উন্নয়নের স্বার্থে তাঁদের বোঝাপড়া চমৎকার। প্রত্যক্ষ কর্মতৎপরতায় মেয়রের ভূমিকা দৃশ্যমান হলেও মাননীয় সংসদ সদস্যের সহযোগিতা ছাড়া মেয়র একক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এই মেলবন্ধনটি ছিল কুমিল্লা শহরের জন্য খুবই ইতিবাচক। কিন্তু কোথায় যেন একটি সমন্বয়ের ঘাটতি এসে শহর কুমিল্লাকে বিগত ৭/৮ বছরে তছনছ করে দিয়েছে। যদি উন্নয়নের কথা বলি- তাহলে বাস করার জন্য অপরিকল্পিত অট্টালিকা নির্মাণ এবং বাজার অর্থাৎ কেনাবেচার জন্য দোকানপাট, নান্দনিক নাম শপিংমল ছাড়া আর তো কোনো কিছু চোখে পড়ছে না। সিমেন্টের ঢালাইর উপর যদি টাইলস স্থাপন হয়, তা তো উন্নয়ন নয় টাকা খরচের শ্রাদ্ধ। লোকে বলে ঢাল টাকা, দিবে গৌরিসেন (সরকার)। প্রজেক্ট দিতে পারে না। টাকা দাও বলে আহাজারি। যত কাজ, তত লাভ।
আমার শহর ‘কুমিল্লা’ বাড়িঘর ও দোকানপাট দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এরূপ কোনো কালে ছিল না। এবং তা কোনো অবস্থায় অর্জন হিসেবে বিবেচ্য নয়। শহর কুমিল্লার অহংকার তেরিপট্টি নয়, কান্দিরপাড়। যেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা হতো- মেধা বিকাশের চর্চা হতো ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে-মোগলটুলির বই-এর দোকান এখন কান্দিরপাড়ে, পত্রিকাগুলোর অফিস এখন কান্দিরপাড় এলাকায়, একটি রাজনৈতিক সভা হতে হলে তা কান্দিরপাড়েই, একটি মিছিল-মানববন্ধন বা প্রদর্শনী হতে হলে এ কান্দিরপাড়েই। এসব অর্জন-ক্ষেত্রটিকে যারা অনান্দনিক করে তুলেছে, সিটি কর্পোরেশনকে এ দায় অবশ্যই বহন করতে হবে। পূবালী চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হয় না, এখানে প্রতিস্থাপিত হয়েছে টেলিভিশন, স্নো-পাউডারের বিজ্ঞাপন। রুচির তারিফ করতে হয়।
আমি আশাবাদী একজন সামান্য নাগরিক। সেজন্য স্বপ্ন আমার পিছন ছাড়ছে না। কাজেই যেকোনো পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ দেখছি না। কী বলতে পারি? তারপরও বলব- অন্তত আমার তথা আমাদের শহর ‘কুমিল্লা’র স্বার্থে রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে যতটুকু সম্ভব ‘নগর কুমিল্লা’কে গড়ে তুলি। ঐতিহ্য যেমন অহংকারের ঠিকানা, তদ্রƒপ ঐতিহ্য সৃষ্টি করা ভবিষ্যতের জন্য আলোকবর্তিকা।
দই মনে করে চুন খেয়ে কুমিল্লাবাসী আতংকে আছে। পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশন হয়ে যে যন্ত্রণা ও অর্থদণ্ডে নাজেহাল অবস্থা, কুমিল্লা বিভাগ হলে মাত্র দুটি অফিস ও কিছু জনবল বাড়বে। কমিশনার ও ডিআইজির অফিস ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। প্রশ্ন-এত বড় ভারী বোঝাটি আমার শহর ‘কুমিল্লা’ কি বহন করতে পারবে? জানি না।
ক্রমশ

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
 মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫