আবদুল আজিজ মাসুদ ||
বলা হয় ব্যাংক আর ট্যাংকের শহর কুমিল্লা। ব্যাংক ব্যবসায়ীদের আধিক্যের কারণে দেশে এখন ব্যাংকের অভাব নেই। কুমিল্লায়ও পাড়ায় পাড়ায় ব্যাংক, তবে যে ইমারত থেকে এ অঞ্চলে ব্যাংক ব্যবসার সূচনা হয়েছিল সেই পূবালী চত্ত্বরের ঐতিহাসিক ইমারতটির সুষ্ঠু সংস্কারের অভাবে আজ অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। একবার ইমারতটিকে ভেঙ্গে ফেলার নানা ষড়যন্ত্রও হয়েছিল। শেষে কুমিল্লার ঐতিহ্য সচেতন নগরবাসীর প্রতিবাদের মুখে সে যাত্রায় রক্ষা হয়েছিল, তবে এখনই সুষ্ঠু সংস্কার করা না হলে একদিন এমনিতেই ইতিহাসের সাক্ষী এই ইমারতটির অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাবে।
যাক যেটা বলছিলাম কুমিল্লার ট্যাংক বা পুকুর নিয়ে কথা। কুমিল্লাকে এখন আর ট্যাংকের শহর বলা যাবে না। সেটা আজ অতীত ইতিহাস। পাড়ায় পাড়ায় এখন আর পুকুর দিঘী নেই। হাতে গোনা কয়েকটি পুকুর দিঘী ছাড়া ইতিমধ্যে সবই ভরাট হয়েগেছে। ভরাট না হওয়া দিঘী গুলোর মধ্যে রয়েছে ছয়শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী “ধর্ম সাগর” দিঘী।
কুমিল্লায় কেউ এলে ধর্মসাগরে অবগাহন না করুক অন্তত ধর্মসাগরের পাড়ে ভ্রমণ না করে গেলে অতৃপ্তিই থেকে যায় কুমিল্লা ভ্রমণ। এ দিঘীর ইতিহাস জানতে চায় অনেকেই। কে শুনাবে তাদেরকে ধর্মসাগরের ইতিহাস। ক’জন ই-বা জানে এর প্রকৃত ইতিহাস? প্রাচীন গ্রন্থ “রাজমালা” ঘেঁটে এ দিঘীর ইতিহাস অনুসন্ধান করার সময় ই- বা আছে ক’জনের? উৎসুকদের সম্মুখে সহজ ভাবে তুলে ধরার জন্য যৌথভাবে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলেন ‘রৌদ্রজল’, ‘জাগ্রত জনতার মঞ্চ’ ও কুমিল্লা জেলা প্রশাসন। ধর্ম সাগরের উত্তর পাড়ে একটি বিলবোর্ড স্থাপন করেছে তারা। এতে রয়েছে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য, পয়ার ছন্দে লিখিত রাজমালার কিছু উদ্ধৃতাংশ ও অর্থ(!) এ উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় তবে বিলবোর্ডটি স্থাপনের পূর্বে আরো সর্তকতা অবলম্বন করা উচিৎ ছিল। কারণ বিলবোর্ডের লেখা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এতে রয়েছে যথেষ্ট বানান ও তথ্যের ভুল। যেমন, বিলবোর্ডে উল্লেখ রয়েছে, রাজা ধর্ম মাণিক্য নিজের নামানুসারে দিঘীটি উৎসর্গের সময় তাম্রলিপি চয়ন করা হয় ঃ-
“চন্দ্র বংশোতে (বংশেতে) মহামাণিক্য নৃপবর।
তানপুত্র শ্রীধর্ম (ধর্ম্ম) মাণিক্য শশধর ॥
তেরশ আশি শতকে (তের শত আশী শকে) সোমবার দিনে।
শুল্ক (শুক্ল) পক্ষ ত্রয়োদশী মেঘ (মেষ) সংক্রমণে ॥
তাম্র পত্রে লিখি দলি (দিল) এ সব বচন।
আমা বংশে (বংশ) মারি যেবা হয় তা (ত) রাজন ॥
তাহার দাশের দাশ (দাসের দাস) হইবেক আমি।
আশা (আমা) কীর্তি (কীর্ত্তি) ব্রহ্মবৃত্তি না লঙ্ঘিয় (লঙ্ঘীও) তুমি ॥”
(রাজমালা, ২য় লহর পৃ-৩)
(পাঠকদের সুবিধার্থে ব্র্যাকেট বন্ধনীতে রাজমালার প্রকৃত পাঠ উল্লেখ করা হয়েছে।)
তাম্র লিপির অর্থ করতে গিয়ে বিলবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে ঃ-
“চন্দ্র বংশোদ্ভুত মহামাণিক্যের সুধীপুত্র শশধর শ্রীধর্ম মাণিক্য ১৩৮০ শতকের মেঘ সংক্রম অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ তারিখে সোমবার শুক্ল ত্রয়োদশী তিথিতে কৌথুকান্দির তুষ্ঠ বিপ কক্ষে শস্য সমন্বিত ও ফল বৃক্ষাদিপূণ উনত্রিশ দ্রোন ভূমিদান করলেন। আমার বংশ বিলুপ্ত হলে যদি এই রাজ্য কোন ভূপতির হস্তগত হয়, তিনি এই ব্রহ্মবৃত্তি লোপ না করলে আমি তার দাসানুদাস হবো।”
পন্ডিত শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর শর্ম্মা এবং চন্তাই দুর্ল্লভেন্দ্র নারায়ণ কর্তৃক বাংলায় পয়ার ছন্দে রচিত ও শ্রী কালী প্রসন্ন সেন বিদ্যাভূষণ কর্তৃক সম্পাদিত বাংলা রাজমালার ২য় লহরের উদ্ধৃতাংশকে আবার বাংলায় অর্থ করার কি উদ্দেশ্য, বোধগম্য হলো না। যা করা যেত, তাহলো দুর্বোধ্য শব্দের সহজীকরণ বা ব্যাখ্যা করা যেতো। তাছাড়া উদ্ধৃতাংশের অর্থ করলে তো হুবুহু অর্থ করতে হবে, এখানে অর্থ করতে গিয়ে অতিরিক্ত তথ্য সংযোজন করা হয়েছে যেমন অর্থের তৃতীয় লাইনে আছে, “কৌথুকান্দির তুষ্ঠ বিপ কক্ষে” শব্দগুলো অতিরিক্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এগুলোর অর্থই বা কি? এগুলো তো উদ্ধৃতাংশে নেই। তাছাড়া বানান ভুল, তথ্যের ভুল তো রয়েছেই। আসলে অতিরিক্ত জুড়ে দেয়া শব্দগুলো রয়েছে রাজমালার মধ্যমণিতে সংস্কৃত শ্লোকের মর্মে, যার প্রকৃত পাঠ হলো “কৌতুকান্দি অষ্ট বিপ্রকে” (রাজমালা ২য় লহর মধ্যমণি পৃ: ৯৩, পারুল প্রকাশনী, আগর তলা ২য় সংস্করণ ২০০৩) সহজ ভাষায় বলা যায়, অষ্ট বিপ্র হচ্ছে আটজন ব্রাহ্মণ। “কৌতুক” সম্পর্কে রাজমালায় উল্লেখ রয়েছে, “সংস্কৃত রাজমালায় লিখিত আছে আটজন ব্রাহ্মণকে ভূমি দান করা হয়েছিল। তন্মধ্যে কৌতুক ও বানেশ্বরের নাম রাজমালায় পাওয়া যায়। কৌতুক কান্য কুঞ্জবাসী, ইনি বারানসী ধাম হইতে ধর্ম্মমাণিক্যের সঙ্গে আসিয়া ছিলেন।”
(রাজমালা ২য় লহর মধ্যমণি পৃ: ৯২ পারুল প্রকাশনী, আগরতলা ২য় সংস্করণ ২০০৩)
“কুমিল্লার ধর্মসাগর উৎসর্গোপলক্ষে মহারাজ ধর্ম্ম আট জন ব্রাক্ষণকে কালিয়াজুড়ি প্রভৃতি গ্রামের ভূমিদান করিয়াছিলেন। তন্মেধ্যে কৌতুকের নাম ও পাওয়া যায়। (রাজমালা ২য় লহর মধ্যমণি পৃ:২৫২)
উল্লেখ্য বিলবোর্ডে তাম্রলিপির যে অর্থ লিখা হয়েছে তা হচ্ছে রাজমালার ২য় লহরের মধ্যমণির সংস্কৃত শ্লোকের মর্ম। যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাও আবার ভুল-ভ্রান্তিতে ভরপুর। যেমন তাম্রলিপির অর্থের ২য় লাইনে লিখা হয়েছে “১৩৮০ শতকের মেঘ সংক্রম অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ তারিখে” অথচ রাজমালায় রয়েছে “১৩৮০ শকের মেষ সংক্রমণে”।
প্রথমে আসি ‘শক’ আর ‘শতক’ এর মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কেঃ ‘শতক’ হচ্ছে শত সংখ্যা, আর ‘শক’ হচ্ছে রাজা শাকাদিত্য বা শালিবাহন যিনি শকাব্দ প্রবর্তন করেন বা শকাব্দ শক নামক রাজা কর্তৃক প্রবর্তিত সাল (বঙ্গাব্দের ৫১৫ বছর আগে থেকে শকাব্দ চালু রয়েছে। খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৮/৭৯ বিয়োগ করলে শকাব্দ পাওয়া যায়) (সূত্র: ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি)
দ্বিতীয়তঃ ‘মেষ’ সংক্রমণ হচ্ছে- রাশি চক্রের প্রথম রাশি মেষ। “সূর্য মীন রাশি হইতে যে সময় মেষ রাশিতে সংক্রান্ত (প্রবিষ্ট) সেই সংক্রান্তিকে মহা বিষুব বা মেষ সংক্রান্তি বলে। এই সময় দিবা রাত্রি সমান বলিয়া ইহার নাম মহাবিষুব। ইহার অপর নাম চৈত্র সংক্রান্তি। এই সংক্রমণ দিন অতিশয় পূন্যাহ্ বলিয়া গণ্য”। (রাজমালা ২য় লহর পৃ: ৫)
আদি গ্রন্থের পাঠ সংশোধন, ভাষারীতি পরিবর্তন করা মূল গ্রন্থপ্রণেতার রচনায় অযাচিত হস্তক্ষেপের শামিল। মূল পাঠ অক্ষুন্ন রেখে প্রয়োজনে দ্রষ্টব্য বা ফুট নোটে নিজস্ব মতামত দেয়া যেতে পারে। বিলবোর্ডের উদ্ধৃতিতে মূল পাঠে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বারবার যা রাজমালার প্রাচীনত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে করি।
সর্বশেষে শচীন দেব বর্মণের একটি বিখ্যাত গানের কলি উল্লেখ করে বিলবোর্ডে লিখা হয়েছে “শোনো গো দক্ষিণ হাওয়া, প্রেম করেছি আমি। শচীন দেব বর্মণের গানে, জাতীয় কবি নজরুলের কবিতা এই ধর্মসাগরের পাড়ে বসেই রচিত”। প্রশ্ন হলো শচীন দেব বর্মণের গাওয়া বিখ্যাত এই গানটি কি জাতীয় কবি নজরুলের কবিতা? যা এই ধর্মসাগরের পাড়ে বসেই রচিত। এ প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মী ‘পরমা’র একটি উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য সূত্রের বরাদ দিয়ে ‘পরমা’ ভারত বিচিত্রা নভেম্বর ২০২০ সংখ্যায় ‘শোন গো দখিনো হাওয়া’ শিরোনামে লিখেছেন, “বাংলা গানের জগতে মীরা ধর তথা মীরা দেব বর্মণ অন্যতম সার্থক গীতিকার। তার লেখা গানের মধ্যে আছে, শোন গো দখিন হাওয়া.............”। তাহলে ‘পরমা’র তথ্য সঠিক হলে বিলবোর্ডের এই লেখাটি সংশোধনসহ পুরো বিলবোর্ডের লেখা সংশোধিত আকারে পুনঃস্থাপন অতি জরুরী। না হয় ভুল বার্তা নিয়ে ঘরে ফিরবে দর্শনার্থী উৎসুক জনতা। সেই সাথে ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার সমৃদ্ধ সাহিত্যাঙ্গন সম্পর্কে বিরূপ ধারণার উদ্ভব হবে সুধীসমাজে।
লেখক: আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
মোবাইল: ০১৭১১-৪৬৪২১৩