জহির শান্ত: পুত্রবধূর হাতে নৃশংসভাবে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি খুন হওয়ার বিষয়টিকে সুবর্ণপুর গ্রামের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে আখ্যায়িত করছেন গ্রামবাসী। আর এ জন্য মানুষের নৈতিক স্খলন, পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব এবং আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবকেও কিছুটা দায়ি করছেন তারা। মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যেই যে ঘটনাই থাকুক- দোষীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন সুবর্ণপুর ও এর আশপাশের এলাকার মানুষ।
গতকাল বুধবার বিকেলে কুমিল্লার গোমতী নদী লাগোয়া সদর উপজেলার সুবর্ণপুর গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বললে তারা এ বিষয়টি তুলে ধরেন।
গত ৫ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে কুমিল্লার সুবর্ণপুরের নিজ বাড়িতে খুন হন পল্লী চিকিৎসক সৈয়দ বিল্লাল হোসেন ও তার স্ত্রী সফুরা খাতুন। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য ২৪ ঘন্টার মধ্যেই উদ্ঘাটন করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী নাজমুন নাহার চৌধুরী ওরফে শিউলি এবং তার দুই সহযোগী জহিরুল ইসলাম সানি ও মেহেদী হাসান তুহিনকে। পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বুধবার বাদ আসর সুবর্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পৃথক দুটি জানাজা শেষে নিহত দম্পতি বিল্লাল হোসেন ও সফুরা খাতুনকে বাড়ির পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
সুবর্ণপুর স্কুলমাঠে জানাজার পূর্বে জিয়াউল হক জীবন নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমাদের মানবিকতা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সমাজ অধ:পতিত হচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতিক প্রভাবে পারিবারিক মূল্যবোধ বিষ্ট হচ্ছে। যার কারণে এমন হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ড সুবর্ণপুরকে কলংকিত হচ্ছে। অতীতে এমন বর্বর, মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা কখনো এ গ্রামে ঘটেনি।
বিষয়টির সাথে একমত পোষণ করে কুমিল্লা সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান তারিকুর রহমান জুয়েল বলেন, এ ঘটনা কেবল সুবর্ণপুর নয়- পুরো সদর উপজেলাকেই কলংকিত করেছে। দেশের বিভিন্ন সাথে নানা ধরনের খবর প্রতিনিয়ত পেলেও এ জনপদে কখনো এমনটা ঘটেনি।
তিনি বলেন, ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার সুযোগ নেই। প্রশাসন অত্যন্ত তৎপর ও বিচক্ষণ। দোষিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আসামিরা অবশ্যই শাস্তি পাবে।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, খুন হওয়া দম্পতি বিল্লাল হোসেন ও সফুরা বেগম দুই পুত্র ও দুই কন্যার জনক-জননী। তাদের দুই ছেলেই প্রবাসে থাকেন। হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত শিউলি তাদের বড় ছেলে দুবাই প্রবাসী সৈয়দ আমান উল্লাহ দিদারের স্ত্রী।
হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এলাকাবাসীর কেউ বলছেন, দীর্ঘ পারিবারিক কলহের জের ধরে পূর্ব পরিকল্পনা মতো দুই সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে হত্যা করে পুত্রবধূ শিউলি। আবার কেউ বলছেন, মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে পুত্রবধূর পরকীয়া ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের রেশ। যদিও পরকীয়া কিংবা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে পুলিশ বলছে, দীর্ঘদীনের জমে থাকা ক্ষোভ থেকেই এই জোড়া খুন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা তিনজনকে গ্রেফতারের পর আদালতে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গিয়েছে। এরপর তিন খুনিকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় নিহত বিল্লাল হোসেনের চাচাতো ভাই সৈয়দ আবুল হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, অতীতে তাদের পরিবারে কিছু ঘটনা ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনাগুলো মানসম্মানের ভয়ে বিল্লাল ভাই লুকিয়ে রেখেছিলেন। শুনেছি কোনো এক কারণে একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরের পর পুত্রবধূ শিউলিকে এ পরিবারে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে আনাটাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৃশংসভাবে খুন হতে হয়েছে।
জাভেদ হোসেন শুভ নামে এক প্রতিবেশি বলেন, আগে একবার ঘর থেকে স্বর্ণ চুরি করে ধরা পড়েন শিউলি। এছাড়াও সে কিছু অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলো। এগুলো জানাজানি ও ধরা পড়ে যাওয়ায় রাগে-ক্ষোভে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
সফুরা বেগমের বোনের ছেলে মিয়াবাজার এলাকার রাশেদ বলেন, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার খালা এবং খালুকে খুন করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।
মাজেদা বেগম নামে এক নারী বলেন, অভিযুক্ত গৃহবধূ শিউলির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। যেনো এ থেকে অন্যরাও শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। ভবিষ্যতে কেউ যেনো এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে সাহস না পায়।
পাঁচথুবি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন বাহালুল বলেন, সৈয়দ বিল্লাল হোসেন অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তাকে আমরা গরীবের ডাক্তার হিসেবে চিনতাম। এ দম্পতির এমন নির্মম হত্যা মেনে নেয়া যায় না। হত্যার পর ওই মহিলা (শিউলি) নাটক সাজাতে শুরু করে। সে ঠান্ডা মাথায় নানা চাল চালতে থাকে। শ্বশুর শাশুড়ির সাথে তার মনোমালিন্য ছিলো। এর জের ধরেই হত্যাকাণ্ড।
তিনি বলেন, দ্রুত এ হত্যার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য প্রশাসনকে ধন্যবাদ। তারা বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। অভিযুক্ত সবাই গ্রেফতার হয়েছে। অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হয়নি। আমি দোয়া করি, এ সংসারটা আগামীতে ভালো থাকু।