ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত
রাগ না থাকা
বা রেগে না যাওয়া, একই সঙ্গে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া। যে কোনো জীবকে
ভালোবাসতে পারার অর্থ হলো পুরো পৃথিবীটা তোমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর হয়ে
যাওয়া, অর্থপূর্ণ হওয়া। তাই সব সৃষ্টি, সবকিছু ভালোবাসতে হবে হৃদয় থেকে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে-
One who has anger does not/Require an enemy/One who has knowledge/ Does not require/wealth One who has kindness/Does not require protection
দ্বিতীয় বাক্যটির শেষ অর্ধেক
দেখলেই শরীরটা জ্বলে ওঠে। মনটা তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। কেননা দয়ার
সাগর, অত্যন্ত শিশুসুলভ, অফুরন্ত ভালোবাসার ব্যক্তি ছিলেন আমাদের জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ভালোবাসার কী প্রতিদান দিলাম আমরা!
অথচ তিনি আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি।
শুধু জ্ঞান নয়- চরিত্র, সততা,
নিয়মানুবর্তিতা, আন্তরিকতা, ব্যবহারও মানুষের বড় সম্পদ। অর্থ যে বিশাল কোনো
সম্পদ নয়- তা বর্তমান, অতীত, রাজা-উজির, জমিদার-প্রজার দিকে তাকালেই
স্পষ্ট হয়ে যায়। আজ যিনি প্রচ- ধনী, কালই তিনি ভিখারি। তার পেছনের কারণ
বিশ্লেষণ করার সুযোগ আমাদের নেই। ইতিহাস পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ করলে যা
পাওয়া যায়, তা হলো তাদের সম্পদ ছিল। কীভাবে আহরিত, তা অনেক ক্ষেত্রেই গোপন
থেকে যায়। অথবা যখন তারা সম্পদ আহরণ করেন, তখন তারা এতই ক্ষমতাবান বা
প্রতাপশালী থাকেন- কীভাবে সম্পদ আহরিত হলো, তা খুঁজতে গেলেও অনুসন্ধানকারীর
জীবন বিনষ্ট হতে পারে। এমনকি অনুসন্ধান তো দূরের কথা, তাদের সম্পদ নিয়ে
আলোচনা-সমালোচনা করলেও ব্যক্তির মু-পাত হয়ে যেতে পারে।
উপমহাদেশে মানুষ
তিনবার সম্পদ অর্জনের সুযোগ পেয়েছিল। প্রথমটা ইংরেজদের তোষামোদি অথবা
দালালি না বলে অসাধারণ সহযোগিতা করে। কিন্তু সেখানে একটা ব্যালান্স ছিল।
কেননা পরাশক্তি, লুটেরা শক্তি অথবা দখলদার তাদের শাসনব্যবস্থা চালানোর জন্য
এসব লোককে সাহায্য করে তাদের সহজলভ্য সুযোগ-সুবিধা ও প্রশাসন চালানোর
জন্য। পরে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৭-পরবর্তী ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা
মুসলিমদের একাংশ ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দুদের একাংশ- যাদের
বুদ্ধি, সুযোগসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিপক্ব ছিল। কখনো কখনো তারা
ব্রিটিশদের সাহায্য করার জন্য বিশাল বাহিনী তৈরি করে সমষ্টিগতভাবে সম্পদ
অর্জনে লিপ্ত ছিলেন এবং সার্থক হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের পর যারা ধনী
হয়েছেন, তাদের আমরা চিনি। তারা আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছিলেন। পথ ছিল
অতন্ত সহজ। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের সম্পদ ফেলে গেছেন অথবা কিছু সম্পদ
তাদের বিশ্বস্ত বাঙালি নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারীদের কাছে আমানত রেখে
গিয়েছিলেন। তাদের এই সম্পদ লুণ্ঠনে আমাদের বাঙালি বিরাট ধনী হয়েছেন। অর্থাৎ
ওই পুঁজিই ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং বিপদের পুঁজি। তারা আবার এক জায়গায়
ব্যর্থ হয়েছিলেন। পুঁজিকে দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ করার যোগ্যতা তাদের ছিল না।
১৯৭৫ সালের পর সামরিক সরকারের আমলে কতিপয় সুবিধাভোগী নেমে পড়লেন লোনের নামে
ব্যাংক লুটের মহোৎসবে। লোনদাতা ও গ্রহীতার অতিরিক্ত লোভ-লালসা মানুষকে
পঙ্গু ধনীতে রূপান্তর করে। তারা টাকা সৎপথে আয় করে কর প্রদান বৃদ্ধি করতে
পারেননি। পেরেছেন ভোগবিলাসিতার মধ্যে দেখাতে যে, তারা ধনী লোক। কারণ তাদের
সামনে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভব
ছিল না। মনে ছিল দুর্বলতা। দ্বিতীয়ত, তারা নিজেকে সেই রকম পরিমাপ করতে
পারেননি। তেমনি ব্যবসাকে মাপার কোনো ইচ্ছা ও যোগ্যতাও তাদের ছিল না।
তৃতীয়ত, লক্ষ্য হতে হয় অর্জনযোগ্য। কিন্তু তাদের সে লক্ষ্য নির্ধারণ বা
পূরণেরও ছিল না কোনো যোগ্যতা। ছিল না কোনো বাস্তবমুখী চিন্তা এবং সৎ
সুযোগের সদ্ব্যবহারের কোনো উদ্দেশ্য। একবার অসৎ পথে পা দিলে সেখান থেকে
ফিরে আসা যায় না। লোভ যে শুধু তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, তা নয়- সমাজ ও
রাষ্ট্রকেও ধ্বংস করে দেয়। ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত শব্দ ঞরসব ইড়ঁহফ অর্থাৎ
শুরু ও শেষের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকতে হবে। ১৯৭১ সালের পরে লুটেরা, গচ্ছিত
সম্পদ বা গচ্ছিত সম্পদ চুরি করে যারা বড় হতে চেয়েছিলেন- তাদের ঊর্ধ্বগতি
রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হয়নি। Specific, Measureable, Achievable, Realistic I Time Bound শব্দগুলোর আদ্যাক্ষর নিলে যা দাঁড়ায়, তা হলো SMART।
স্মার্ট শব্দটির বহুমুখী প্রয়োগ হয়। ঝগঅজঞ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো
বুদ্ধিমান, দক্ষ বা তীক্ষè, চটপটে ইত্যাদি। তা বহুল ক্ষেত্রে প্রচলিত ও
ব্যবহৃত। অর্থাৎ তারা ছিলেন সম্পদ ভোগে SMART, অপচয়ে SMART লালসা চরিতার্থে SMART।
হিন্দুশাস্ত্রে (আমি এখানে ধর্ম বলিনি) বেশ পরিবর্তন হয়েছে।
যেহেতু সবচেয়ে পুরনো ধর্ম বা শাস্ত্র- সেহেতু তা সংশোধন, পরিবর্তন,
পরিমার্জন ছিল যুগের দাবি। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তি পরিচায়ক হয়েই
হয়েছে। যারা করেছেন, যেমন- সতীদাহ রোধ করেছেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮২৯ সালে
লর্ড বেন্টিক সপ্তদশ বিধি দ্বারা বিধবা বিয়ে বৈধ করেন। এর মূলে ছিলেন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও তার সহযোগী রানি রাসমনি। পুরনো এই শাস্ত্রেও এক
অমোঘ বাণী- ‘ধনের দেবী লক্ষ্মী যখন ঘরে আসে, বিদ্যা দেবী সরস্বতী তখন
পেছনের দরজা দিয়ে পালায় এবং সম্পদ কখনো কোনো ব্যক্তির ঘরে তিন প্রজন্মের
বেশি থাকে না।’
তাই পৃথিবীর সম্পদশালী ব্যক্তিদের জন্য একটা ধ্রুব সত্য
তুলে ধরছি Shiv Khera `You can win' page-248)- ১৯২৩ সালে প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের শেষে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮ ব্যক্তি একত্র হয়েছিলেন। তখন তাদের
সমষ্টিগত সম্পদের পরিমাণ ছিল, ওই সময়ের যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সম্পদের চেয়ে
বেশি। তারা নিশ্চয়ই এটুকু জানতেন কী করে বসবাস করা যায়, সম্পদের পরিমাণ
বাড়ানো যায় এবং সম্পদ সংগ্রহ করা যায়। এখন দেখি ২৫ বছর পর ১৯৪৮ সালে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের কী পরিণতি হয়েছিল-
1. President of the largest steel company, Charles Schwab, lived on borrowed capital for five years before he died bankrupt. 2. President of the largest gas company, Howard Hubson, went insane. 3. One of the greatest commodity traders, Arthur Cutton, died insolvent. 4. President of the New York Stock Exchange, Richard Whitney, was sent to jail. 5. A member of the PresidentÕs Cabinet, Albert Fall, was pardoned from jail to go home and die in peace. 6. The greatest æbearÕÕ on Wall Street, Jessie Livermore, committed Suicide. 7. President of the worldÕs greatest monopoly, Ivar Krueger, committed suicide. 8. President of the Bank of International Settlement, Leon Fraser, committed suicide.
তারা ভুলে গিয়েছিলেন
কীভাবে আদর্শ জীবনযাপন করতে হয়। তারা ভুলে গিয়েছিলেন ‘অর্থই সব অনর্থের
মূল’। তারা মনে করতেন, টাকা তাদের সমস্যা নয়। তারা শুধু অর্থ উপার্জনে গিয়ে
জীবনের ঝঢ়ড়শবং ড়ভ ষরভব অর্থাৎ ৫ঋ। তা হলো ঋধসরষু, ঋরহধহপবং, ঋরঃহবংং,
ঋৎরবহফং ধহফ ঋধরঃয বিসর্জন দিয়েছিলেন। এ পাঁচটির প্রতিটি সমানভাবে
অত্যাবশ্যক জীবনের চাকাকে ভারসাম্য, চলমান ও বৃত্তের মধ্যে রাখতে। আমাদের
শুধু তিন ধরনের শিক্ষা দরকার। তা শিক্ষা দেবে কীভাবে মার্জিত জীবনযাপন করা
যায় (যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন প্রজ্ঞা)। দ্বিতীয়ত, কীভাবে
স্বাস্থ্যকর ও নিয়মমাফিক জীবনযাপন বা বসবাস করা যায়। তৃতীয়ত, অপচয়ের পথগুলো
রুদ্ধ করা যায়।
সর্বশেষ একটি উদাহরণ- কোনো পেশাজীবী ব্যক্তিকে যদি
জিজ্ঞেস করা হয়- কেন আপনি দিনরাত পরিশ্রম করছেন অথচ পরিবারকে, নিজের
শরীরকে, এমনকি সমাজের দায়িত্ব পালনও করছেন না? বিদ্রƒপভাবে তিনি জবাব
দেবেন, আমি সবকিছু করছি আমার পরিবারের জন্য। আমরা যখন কাজে বের হই, তখন
সন্তানরা ঘুমায়। আবার যখন ফিরে আসি, তখন তারা ঘুমায়। ২০ বছর পর দেখি তারা
বড় হয়ে সবাই নিজের মতো চলে গেছে। তখন আর পরিবার থাকে না।
লেখক:সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়