স ম মাহবুবুল আলম ||
স্বাস্থ্যসেবা পেতে মানুষের অসহায়ত্ব অত্যন্ত প্রকট। আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে মানুষ। জায়গা-জমি বিক্রি করে, সঞ্চয় ভেঙ্গে, ঋণ করে চিকিৎসার খরচ জোগাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর দরিদ্র হয়ে পড়ছে। তারপরও হতভাগ্য মানুষ মানসম্মত ও নিরাপদ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারছে না।
বাংলাদেশের একটি বিস্তৃত ও শক্তিশালী স্বাস্থ্য অবকাঠামো আছে। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিটি বাড়ি ঘুরে স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা রেখে কয়েক স্তরে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এই স্বাস্থ্য অবকাঠামো পরিচালনা করতে সরকার বিরাট অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু জনগণ এই ব্যয়ের সুফল খুব অল্পই পাচ্ছেন। এই অবকাঠামোর ভেতরেই আরো উন্নত সেবা দেয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু পারছে না। এর প্রধান কারণ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুল সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। তবে কাঙ্ক্ষিত উচ্চমানে স্বাস্থসেবাকে নিতে হলে সরকারকে অবশ্যই বাড়তি বাজেটের সংস্থান করতে হবে ও স্বাস্থ্যখাতে জনশক্তি বৃদ্ধি ও তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। বিগত বছরগুলিতে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের পথ নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা যায়। তারা বিদেশের অনুকরণে উন্নত বেসরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে সমাধান খুঁজেছেন। যা স্বাস্থ্যসেবায় নৈরাজ্য, অনৈতিকতা ও হাহাকার বাড়িয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে পাবলিক সেক্টরকে শক্তিশালী করতে হবে। বছরের পর বছর স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি নাই। সক্ষমতার অভাবে নয়, সরকারের দূরদৃষ্টি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এমনটি ঘটেছে। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ একটি জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ সরাসরি স্বাস্থ্যখাতে নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করবে। শ্রমবাজারে সবল, সুস্বাস্থ্যের জনশক্তির প্রবেশ ঘটাবে। শিশুদের স্কুল অনুপস্থিতি কমে যাবে। দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখবে এবং অর্থনীতিতে গতিশীলতা তৈরি করবে।
সবার আগে এই স্বল্প বরাদ্দের বাজেটের পরিকল্পিত সদ্ব্যবহারের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। অপচয় রোধ করতে হবে এবং দুর্নীতি দমন করতে হবে কঠোর হাতে।
সরকারের প্রথম লক্ষ্য হতে হবে, শক্তিশালী পূর্ণাঙ্গ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো গড়ে তোলা। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা হচ্ছে একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বুনিয়াদ যা সবচেয়ে সাশ্রয়ীভাবে স্বাস্থ্যসেবা দিতে সক্ষম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যক্তি ও পরিবারকে আর্থিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তিতে সমতা বৃদ্ধি করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই শাখা স্বাস্থ্য বিভাগ ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের জনশক্তি মাঠ পর্যায়ে একই কাজের পুনারাবৃত্তি করে জনবল ও অর্থের অপচয় করছে। এতে বৈরিতা তৈরি হয়ে কাজের গতি নষ্ট হচ্ছে। সরকারি কয়েকটি উঁচু পদ হারানোর আশঙ্কা এই দুই বিভাগকে একীভূত করতে বাধা হয়ে আছে। এই বাধার অপসারণ হলে গ্রামীন জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতিতে দুই বিভাগের অর্থ ও জনশক্তির আরো কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। লেখার শুরুতে বাংলাদেশের যে কয়েক স্তর বিশিষ্ট (বাড়ি থেকে সেবা, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাবসেন্টার, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র , উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স) শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর কথা বলা হয়েছে তা পুরোপুরি গ্রামীন জনগোষ্ঠীর জন্য। এখানে নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দ্রুত নগরায়নের প্রক্রিয়ায় এখন মোট জনসংখ্যার ৩৬.৬ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি মানুষ বাংলাদেশের নগর এলাকাগুলোতে বসবাস করছে। এবং এর এক তৃতীয়াংশ বস্তিবাসী। নগরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের। তাদের সেই সামর্থ্য নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে তা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত উন্নত করতে হলে চিহ্নিত আন্তঃমন্ত্রণালয় ও অন্তঃমন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার এই তীব্র শূণ্যতা পূরণে নগরে গড়ে উঠেছে অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা। রোগীরা উপায়হীনভাবে সরাসরি ঔষধের ফার্মেসি অথবা টারশিয়ারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একটি শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা নির্মাণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় কাঙ্ক্ষিত কার্যকর ‘রেফারেল সিস্টেমে’র শৃংখলা প্রতিষ্ঠা হবে। চিকিৎসক নয় এমন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর ব্যাপক ঘাটতি পূরণে নজর দিতে হবে এবং তা দ্রুত পূরণ করা সম্ভব। গ্রামীন প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কাঠামো নগরেও সম্প্রসারণ করতে হবে। সামাজিক ক্ষমতায়ন ও দায়বদ্ধতার মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জনগণের জন্য নিশ্চিত করবে একটি সম্বন্বিত পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা। আন্তর্জাতিক গবেষণায় প্রতিটি দেশকে অতিরিক্ত জিডিপির কমপক্ষে ১ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অবশ্যই বিনিয়োগ করতে বলা হয়েছে। সরকার একটি এসেনসিয়াল হেলথ সার্ভিস প্যাকেজ (জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজ) তৈরি করেছে। সেখান থেকে শুধু প্রয়োজনীয় ঔষধ, ভ্যাকসিন ও ডায়াগনস্টিক সেবা নিশ্চিত করলে জনগণের জীবন অনেকখানি সহনীয় হয়ে উঠবে। সরকার যে সেবা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করা উচিত। প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে গরমিল মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা, বিশৃংখলা ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করবে।
স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থা একটি অপরিসীম জটিল ও চ্যালেন্জিং প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশের মতো দেশে তা আরও কঠিন। বিশেষতঃ স্বাস্থ্যসেবা ব্যাপক জনশক্তি ও বিভিন্ন দক্ষতার স্বতন্ত্র ব্যক্তির সংমিশ্রণে তৈরি টিমনির্ভর সেবা। বিপুল জনগোষ্ঠীর অগনিত প্রকারের রোগের চাপ, বিবিধ ধরনের সেবা ও তার জরুরী ধরন, চিকিৎসা সেবার অনিশ্চিত ফলাফল, চিকিৎসায় অভাবনীয় ব্যয়, দ্রুত সম্প্রসারমান জ্ঞান ও নতুন প্রযুক্তির সংযোগ, ভঙ্গুর অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি, দুর্বল নিয়ম-ব্যবস্থাপনা, অসংখ্য চিকিৎসা সামগ্রীর নিয়মিত সরবরাহ, সেবা প্রদানকারী ও সেবাগ্রহীতার সাংস্কৃতিক মানের পার্থক্য, আবেগের সংঘাত ইত্যাদির সাথে অনিয়ম ও দুর্নীতির শৃংখলে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা স্বাস্থ্যখাতে শুধু অর্থ ব্যয় বৃদ্ধি করে বা জনবল সংকটের সমধান করে স্বাস্থ্যসেবাকে নিরাপদ ও উন্নত উচ্চতায় নেওয়া সম্ভব হবে না। খণ্ডিত আদেশ, নীতিকথা বা শাস্তির মধ্য দিয়েও তা অর্জন করা দূরুহ। সমগ্র সিস্টেম থেকে প্রতিনিয়ত দ্রুত তথ্য প্রাপ্তি, তদারকি ও মূল্যায়ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু করতে পারলে জনগণের জন্য দ্রুততার সাথে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অসীম শক্তি আমাদের সামনে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। সেজন্য জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি করে একটি জাতীয় স্বাস্থ্য ডেটাবেইজ (তথ্যভাণ্ডার) নির্মাণ করতে হবে। এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সবাই সহজে, স্বচ্ছন্দে সেই ডেটাবেইজে তথ্য যুক্ত (ডাটা এন্ট্রি) করতে পারেন। সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারীদের প্রত্যেকের প্রতিদিনের প্রতিটি কার্যক্রম ডাটায় পরিবর্তিত হয়ে ডেটাবেইজে সংরক্ষিত হবে। ধাপে ধাপে ল্যাব, রেডিওলজি, নতুন প্রযুক্তির উপাত্ত, সেবার মান, আর্থিক তথ্য, চিকিৎসা সামগ্রীর হিসাব, ফার্মেসি, জিপিএস ট্র্যাকিং, স্বাস্থ্যসেবার সূচক ইত্যাদি নানা তথ্যের সন্নিবেশে সমৃদ্ধ ডেটাবেইজ হবে। বিস্তারিত ও হালনাগাদ উপাত্ত স্বাস্থ্যসেবায় পারস্পরিক সংযোগ বৃদ্ধি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও গবেষণায় অত্যন্ত অপরিহার্য। স্বাস্থ্যসেবায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার উন্নত চিকিৎসা সেবা, চিকিৎসার ত্রুটি হ্রাস, সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, প্রশাসনিক দক্ষতা, কাজের গতি ও দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা তদারকির ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেইজ স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি, প্রতারণা ও অপচয় রোধেও হবে বড় ধরনের সহায়ক।
বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও নানা প্রতিবন্ধকতা অবশ্যম্ভাবী। তাই এমন একটা পথ বা পদ্ধতি প্রয়োজন যা ব্যক্তিস্বার্থ বা কোনো শক্তির প্রভাবের বাইরে কাজ করতে সক্ষম। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত জাতীয় স্বাস্থ্য ডেটাবেইজ হবে সেই পথ যা আমাদের নিরাপদ ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে পৌছে দিবে।