ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
গ্রন্থ পর্যালোচনা
মুক্তি সংগ্রামে কুমিল্লা
Published : Wednesday, 22 September, 2021 at 12:00 AM, Update: 22.09.2021 1:12:00 AM
মুক্তি সংগ্রামে কুমিল্লাতাসনোভা জেরিন উলফাত ||
আবুল কাশেম হৃদয় রচিত “মুক্তি সংগ্রামে কুমিল্লা” গ্রন্থটি ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কুমিল্লার কাগজ প্রকাশনী থেকে। গ্রন্থটির প্রথমেই লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলনে প্রেক্ষাপট, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান ও ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লার গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে কুমিল্লার সাংস্কৃতিক সম্মেল, গণঅভ্যুত্থান, রাজনৈতিক আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচনে কুমিল্লার অবস্থা এবং নির্বাচনের ফলাফলের তালিকা উল্লেখ করেন তিনি। অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লার তৎকালীন পরিস্থিতি ছিলো উত্তাল। কুমিল্লার ছাত্রনেতারা সমগ্র কুমিল্লা জুড়ে মিছিল মিটিং, সমাবেশ করে।  গ্রন্থটির লেখক তারিখ অনুসারে কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনের বর্ণনা। বইটিতে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের সমাবেশে আলোচক ও অংশগ্রহনকারীদের নাম উল্লেখ করেন, যার ফলে কুমিল্লার অসহযোগ আন্দোলনের সমগ্র চিত্র প্রকাশ পায়। গবেষক শুধু মাত্র পুরুষ উপস্থিতি নয় বরং নারী এসকল আন্দোলনে উপস্থিতি নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা করেন। ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে গোপনে বিশেষ বিমানে পাকিস্তান চলে যান। যাওয়ার আগে বাঙালি ওপর হত্যাকান্ড চালানোর নির্দেশ দেন। ২৫ শে মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশে যে সশস্ত্র অভিযান চালায় তার সাংকেতিক নাম দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ছিলো কার্যত নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপর পরিকল্পিত গণহত্যা। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতীয়তাবাদী অন্দোলন কে প্রতিহত করাই ছিলো এই অপারেশনের উদ্দেশ্য। ২৫ মার্চ রাতেই কুমিল্লা আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীরা। এই অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হয় অসংখ্য পুলিশ সদস্য। গ্রন্থটিতে ২৫ মার্চ কাল রাতে কুমিল্লার পুলিশ লাইন আক্রমণে পটভূমি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ, কুমিল্লার প্রথম রণাঙ্গণ, সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে লেখক আলোকপাত করেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় যুব অভ্যর্থনা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম, ক্যাম্পে দায়িত্ব প্রাপ্তের নাম, কর্মকর্তাদের নাম, কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধকালীন থানা কমান্ডারদের নাম লেখক তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে বের করে বইতে লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষনের ব্যাবস্থা করেন। গ্রন্থটি রচনার ক্ষেত্রে লেখক যেমন আর্কাইভের নানা জটিল তথ্য-উপাত্ত সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন তেমনি সমগ্র কুমিল্লার সাধারণ জনগণের উপর গণহত্যা, নির্যাতনের, ধর্ষনের অভিজ্ঞতালব্ধ মৌখিকভাষ্যের ইতিহাসকে পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন। বইটিতে লেখক কুমিল্লায় নয় মাসে ব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেন। সশস্ত্র সংগ্রামকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে তিনি লিপিবদ্ধ করায়, কুমিল্লায় কখন কোন যুদ্ধ হয়েছিলো তা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। বইটিতে লেখক কুমিল্লার রণাঙ্গনে যুদ্ধে সম্পর্কিত দেশের এবং বিদেশের পত্র-পত্রিকার কলাম তুলে ধরেন।  গণহত্যা নারী নির্যাতন অংশে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যা কান্ডের অনুপুঙ্খ বণর্না ও বিশ্লেষণ করেন। ক্যান্টনমেন্টে অবস্থার বিবরনে রমণী শীলের জবানি ব্যাখ্যার মাধ্যমে উঠে এসেছে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরের অপ্রকাশিত কর্মকান্ডের কথা। বইটির তথ্য অনুযায়ী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের গণকবর সম্পর্কে ধারনা লাভ করা যায়। কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধকালে অ্যান্থনী মাসকারেনহাস আসেন এবং তার দৃষ্টিতে কুমিল্লার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক এই বইটিতে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি থাকায় তারা নয় মাস নির্বচারে সমগ্র কুমিল্লা অত্যাচার, লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ কার্যক্রম চালিয়েছে আর তাদের এই কাজের উৎসাহ প্রদান করেছে মানবতা বিরোধী অপরাধীরা। অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। তাদের সাথে থাকত গ্যাসোলিন ও পেট্রোল। বাড়িগুলোতে তারা পেট্রোল ছড়িয়ে দিত, তারপর ছুড়ে দিতো ফ্লেম থ্রোয়ার। দাউ দাউ করে আগুন জ¦লে উঠত। যারা আগুন ভেদ করে বেরিয়ে আসত, মেশিনগানের গুলিতে তারা লুটিয়ে পড়তো মাটিতো। অসহায়ভাবে দাপাদাপি করত জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যেত। কুমিল্লার গ্রামে গ্রামে হত্যাকান্ড চালায় পাকিস্তান বাহিনী। কুমিল্লা লাকসাম সিগারেট ফ্যাক্টরি, বেলতলী বধ্যভূমিসহ কুমিল্লা কয়েকটি গণহত্যার স্থান শনাক্ত করে লেখক বইয়ে উপস্থাপন করেছেন। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিদের কুমিল্লায় তৎপরতা নিয়ে দলিল ও তাদের আলোচনার স্থানের সিদ্ধান্তসমূহ লিপিবদ্ধ করেন। বইটিতে লেখক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পুলিশ সদস্য, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করেছেন সমগ্র কুমিল্লার। পরিশিষ্ট অংশে কুমিল্লার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা পত্রপত্রিকার অনুচ্ছেদ তুলে ধরায় পরবর্তী প্রজন্মের গবেষণার নানা প্রয়োজনীয় তথ্য বইতে উঠে এসেছে। আলোকচিত্র অংশে লেখক মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের কিছু চিত্র দিয়েছেন যার মাধ্যমে কুমিল্লার যুদ্ধকালের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়। এখানে উল্লেখ্য বিষয়বস্তু যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব বেশি মানুষ কাজ করতে আগ্রহী ছিলোনা তখনই গবেষক আবুল কাশেম হৃদয় এই বইটির কাজ শুরু করেন। তিনি স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষে থেকে নানা রকম হুমকির শিকার হয়েও কাজ বন্ধ করেননি। তিনি বইটিতে তথ্য উল্লেখ করেন নির্দ্বিধায় উল্লেখ করেন। বর্তমানেও তিনি কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চাকে বিকশিত করার জন্য গবেষণা করে যাচ্ছেন।  

তাসনোভা জেরিন উলফাত (নিশাত)।
শিক্ষার্থী: বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।