ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি
Published : Thursday, 23 September, 2021 at 12:00 AM
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী ||
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বহু আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। কিছু পরিবর্তন হলেও সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নানা ধরনের অপরিকল্পিত নামধারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশব্যাপী যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে সুশিক্ষিত জাতি গঠন অনেকটাই সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। ২০১০ সালে নতুন শিক্ষানীতি গৃহীত হলেও এ পর্যন্ত শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক কাঠামোই দাঁড় করানো যায়নি। অথচ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা এই সময়ে যতটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে তার সঙ্গে সংগতি রাখার বাস্তবতা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য যে ধরন ও মানের শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা প্রয়োজন, সে ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় খুব একটা কার্যকর নেই। সুতরাং দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে শিক্ষার মূলধারায় ফিরিয়ে আনা ছাড়া ঘন জনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা; আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে পরিকল্পনা মোতাবেক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মোটেও সম্ভব নয়। সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন করা ছাড়া আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা বাংলাদেশের জন্য একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার হবে। এর ওপর কভিড-১৯-এর অভিঘাতে বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটিকে দাঁড় করানো এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে একীভূত করা খুবই কঠিন একটি কাজ হবে। তবে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ এবং মৌলিক পরিকল্পনা মোতাবেক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর অবস্থান থাকলে সম্মুখের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অনেকটাই সম্ভব হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
১৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক যে খসড়া শিক্ষাক্রম উপস্থাপিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী যেটির অনুমোদন দিয়েছেন, সেটি এরই মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনার জন্য শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের কাছে রয়েছে। সবাই প্রস্তাবিত খসড়া শিক্ষাক্রমটি বেশ সুচিন্তিত, সুবিন্যস্ত ও যুগোপযোগী বলে একবাক্যে স্বীকার করছেন। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জটিলতা যেমন রয়েছে, করণীয় উদ্যোগ যথাযথভাবে নেওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের এসব পর্যবেক্ষণও যথেষ্ট যুক্তিনির্ভর। এখন যে কাজে সরকার ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সময়ক্ষেপণ না করে হাত দিতে হবে তা হচ্ছে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের পাইলট পরিকল্পনাগুলো কতটা সফল করা যাচ্ছে সেগুলো দেখা। খসড়া শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা ব্যতিরেকে শিখনভিত্তিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে যে ১০০টি এবং মাধ্যমিকে যে ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটির পাইলটিং করা হবে সেখানে যেসব সমস্যা ও সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হবে, তা নির্মোহভাবে বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে গভীর পর্যালোচনার মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা ধরনের একই পর্যায়ের দেড়-দুই লক্ষাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন করা কতটা সম্ভব হবে, সেটিও গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। চতুর্থ শ্রেণি থেকে ওপরের দিকে যেসব পাঠ্য বই পড়ানো হবে এবং ৬০ শতাংশ শিখনমূলক মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়নের প্রস্তাব কতটা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে, সেটিও যথাযথভাবে নিরূপণ করা দরকার। নবম ও দশম শ্রেণিতে মূল্যায়নের এই হার যথাক্রমে ৫০-৫০ শতাংশ কতটা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে, সেটিও দেখার বিষয়। এই স্তরে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের বিভাজন তুলে দিয়ে সামষ্টিক শিখনফল কিভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্জনের ব্যবস্থা করা যায়, সেটি করার ক্ষেত্রে বর্তমানের বাধাগুলো কিভাবে দূর করতে হবে, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষার ধরনটি কিভাবে অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও জ্ঞানভিত্তিক শিখনফল শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাচাই করা যাবে, সেটি শিক্ষা প্রশাসনকে উদ্ভাবন করতে হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির প্রস্তাবিত ৩০ শতাংশ শিখনমূলক মূল্যায়ন এবং ৭০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন কিভাবে দুটি পৃথক পাবলিক পরীক্ষায় সমন্বিত করে চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে, সেটি দক্ষ শিক্ষক প্রশাসকের কর্মনিষ্ঠার ওপর নির্ভর করবে। এই পথরেখা বাস্তবায়ন করা বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে সম্ভব নয়, সেটি সহজেই অনুমেয়।
তাহলে করণীয় কী? এখানেই সরকারকে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে তা হচ্ছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যেসব অননুমোদিত সামঞ্জস্যহীন, মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশে অতীতে গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে একটি পুনর্র্নিমাণযোগ্য সংস্কার সাধন করা। এ ক্ষেত্রে সরকারকে যেসব নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। প্রথমত, সারা দেশে গ্রাম ও শহর ভিত্তিক জনবসতির ওপর নির্ভর করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ম্যাপিং করতে হবে। সেখানে বর্তমানে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর কতটা প্রয়োজন আছে, কতটা প্রয়োজনের বাইরে অবস্থান করছে তা নির্ধারণ করতে হবে। হাওর, বাঁওড়, সমতল ও পাহাড় অঞ্চলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার জন্য মাতৃভাষা বা পছন্দের ভাষায় শিক্ষিত হওয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকতে হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক অনুমোদিত বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কলেজ রেখে বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য অন্তত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকারীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও সতর্কতার সঙ্গে যেটি লক্ষ রাখতে হবে তা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ কোনো অবস্থায়ই মানহীন অবস্থায় গ্রহণ করা যাবে না। প্রাথমিক স্তরে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষক নিয়োগ কার্যকর করতে হবে। যাঁদের ঘাটতি রয়েছে তাঁদের ঘাটতি পূরণের সময় দিতে হবে। যাঁরা তা করতে ব্যর্থ হবেন, তাঁদের ব্যাপারে ভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। যত্রতত্র কেজি ও বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, মাধ্যমিক স্তরে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষক নিয়োগ অপরিহার্য। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ব্যবসায় শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, মানবিক, সামাজিক, ধর্ম শিক্ষা, চারুকারু ও শারীরবিদ্যা বিষয়ক শিক্ষক আনুপাতিক হারে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির বিষয়টি চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, উচ্চতর প্রশিক্ষণ দক্ষতা ইত্যাদি ভিত্তিতে পদ বিন্যস্ত করার মাধ্যমে বেতন স্কেল সংগতিপূর্ণ করতে হবে। তাহলেই মেধাবীরা শিক্ষকতা পদে আকৃষ্ট হবেন। শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা আরো যাচাই-বাছাইমূলকভাবে যেন করা সম্ভব হয় সে ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। চতুর্থত, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি বর্তমানে অংশত স্কুল আবার অংশত কলেজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পাঠদানের মানের সংকট বিরাজ করছে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তাঁদের নিয়োগ পরীক্ষা এবং যাচাই-বাছাই হতে হবে অভিন্ন মানের, বর্তমানে এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। পঞ্চমত, শিক্ষকদের মধ্যে কোচিংপ্রবণতা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে যেভাবে অতিমারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন স্কেলটি জীবনধারণের জন্য গ্রহণযোগ্য হলে কোচিং বাণিজ্য নির্ভরশীলতা বন্ধ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে এটিকে অকার্যকর করার ব্যবস্থা করতে হবে। ষষ্ঠত, পাঠ্যপুস্তকগুলো যথেষ্ট সময় দিয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক দ্বারা লেখা ও সম্পাদনার কাজটি নিপুণভাবে করতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের এ ক্ষেত্রে খুব একটা সুখকর হয়নি। সেটি মনে রেখেই পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাক্রম অনুসরণের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। সপ্তমত, শিশু শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সমগ্র পাঠক্রম শ্রেণিভিত্তিক মানসম্মতভাবে পাঠদান, মূল্যায়ন এবং শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত রাখার জন্য উপযুক্ত করে তোলার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, যোগ্যতা এবং শিক্ষকদের মূল্যায়ন একান্তই জরুরি। এর ওপর ভিত্তি করে শিক্ষকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নেওয়ার বিধান সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করতে হবে।
সমগ্র এই বাস্তবতা কার্যকর করা ছাড়া প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম খুব একটা কার্যকর করা যাবে বলে মনে হয় না। এর জন্য প্রয়োজন সব ক্ষেত্রে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ লোকের। সর্বোপরি সরকারের শিক্ষা বাজেট এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিরিখে নতুনভাবে হিসাব করতে হবে। প্রথম দিকে সরকারের শিক্ষা ব্যয় কিছুটা বড় অঙ্কের হলেও অবকাঠামোগত বিষয়গুলো ঢেলে সাজানো গেলে পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ব্যয় সহনীয় হয়ে উঠবে। বাংলাদেশকে আগামী দিনের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়