অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
গরীব
মানুষের জীবন জীবিকার জন্য বনাঞ্চল ও প্রাণীকুল দুটি নির্ভরযোগ্য উপাদান।
কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দুর্বল অবলোকন ও কিছু দূর্নীতিপরায়ন
কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে গাছপালা ও বণ্যপ্রাণী নিধন নৈমিত্তিক দর্শনীয়
ব্যাপার হয়ে উঠেছে। আদিকাল থেকেই ইউনানী, হেকিমি ও কবিরাজী পদ্ধতিতে
কাঁচামাল হিসেবে বিরল প্রজাতির গাছ গাছালি, লতাগুল্ম ও প্রাণীকুলের উপর
নির্ভর করতে হয়। এরই মাঝে অনেক দূর্লভ প্রাণী এমনকি শকুন পর্যন্ত
বিপন্নপ্রায়। অপরিকল্পিত মৎস্য সম্পদ আহরণের ফলে জলজ প্রাণীকুলের অস্তিত্বও
বিপন্ন। জীববৈচিত্র সংরক্ষণ আইন ২০১৭ প্রয়োগ হচ্ছে না। এদিকে পৃথিবীর
জনসংখ্যা ৮০০ কোটি অতিক্রম করার পথে। জীববৈচিত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যায়
প্রায় ১০ লক্ষ প্রজাতি বিলপ্তির প্রহর গুনছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ
দূষণের দায়ভার কিন্তু এ বিশ্বের গোটামানব জাতির উপর বর্তায়। জীববৈচিত্র
বিপন্ন হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে উষ্ণায়ন, নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, বালাইনাশক
ব্যবহার, বনাঞ্চল ধ্বংশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আমাদের এ ছোট দেশটিতে
অত্যাধিক জনসংখ্যার চাপে ইতিমধ্যে অনেক গাছপালা, লতাগুল্ম ও প্রাণীবৈচিত্র
হারিয়ে গেছে অথবা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। জীববৈচিত্র রক্ষায় জনসংখ্যা
নিয়ন্ত্রণের কোন বিকল্প নাই। গাছপালা ও জীবজন্তু সংরক্ষণে যে কোন দেশে
বনাঞ্চল ও জলাশয় অপরিহার্য। তবে দু:খজনক হলেও সত্যি যে দেশে বনাঞ্চলের
পরিমান খুবই কম। সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কিয়দংশ ছাড়া আর নাই বললেই
চলে এবং যা মোট প্রয়োজনের মাত্র শতকরা দশ ভাগ কিন্তু সেথায় প্রয়োজন শতকরা
২৫ ভাগ। মানুষের অপরিনামদর্শিতায় নদী ও সাগরের দুষণ বেড়েই চলছে ফলে
মারাত্মক বিপর্যস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র। একমাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামের
সীতাকুন্ড সমুদ্র উপকুলে চারটি মৃত ডলফিন ভেসে উঠেছে। গত এক বছরে শুধু
কক্সবাজার উপকুলে মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে ২১টি। সমুদ্র ছাড়াও হালদা, কর্ণফুলী
এমনকি তিস্তায়ও মৃত ডলফিন ভেসে উঠা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
জেলেরা সেই পুরানো পদ্ধতিতে মাছ ধরা এবং শিল্পকারখানার বর্জ্যে পানি দুষণে
ডলফিনের মৃত্যু বাড়ছে বলে সকল মহলের ধারনা।
রক্ষিত বনাঞ্চল বন্দোবস্ত
দেবার সুযোগ নাই। কিন্তু কক্সবাজারের ঝিলংজা মৌজার ৭০০ একর রক্ষিত
বনাঞ্চলের জায়গা জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণের জন্য গত জুন’২১
মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বন্দোবস্ত দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। গত রোববার
(১৯.০৯.২১ইং) সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়। ঐ বৈঠকে
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, বন্দোবস্ত দেয়া
জায়গা বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন বনায়ন করা পাহাড়ী এলাকা। পাহাড়ের উচ্চতা
স্থানভেদে ২০ থেকে ২০০ ফুট। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায়
উপকুলীয় এ এলাকায় বনায়ন প্রকল্পের অধীনে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে ১০০ একর
বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। সেখানে প্রাকৃতিকভাবে গর্জন, তেলসুর, চাপালিশসহ
বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। এলাকাটিতে বন্য শুকর, হাতি, বানর, বিভিন্ন
প্রজাতির সাপ ও পাখীরা অবস্থান করে। ঐ এলাকায় প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান স্থাপন
করা হলে প্রতিবেশ ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। মন্ত্রণালয়ের
প্রতিবেদনেও বলা হয় রক্ষিত বনভূমি অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য দীর্ঘ
মেয়াদে বন্দোবস্ত দেয়া উচিত নয় বলে মনে করে বন অধিদপ্তর। বৈঠক শেষে সংসদীয়
কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, এ জায়গা ১৯৩৫ সনে রক্ষিত বনাঞ্চল
হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৮০ সালে এটাকে জাতীয় উদ্যান এবং ১৯৯৯ সনে
ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা হয়। এখানে কোন স্থাপন না করার
বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এসব কারণে এখানে প্রশিক্ষণ একাডেমি
করার কোন সুযোগ নাই বলে সংসদীয় কমিটি মনে করে।
কক্সবাজারের এ বনভূমিতে
সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা
বেআইনি এবং জীববৈচিত্র ও পরিবেশ রক্ষায় হুমকিস্বরূপ। আমরা এ পরিবেশবিরোধী
উদ্যোগের তীব্র নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে এ উদ্যোগ বাতিলের দাবী জানাই।
২০০১ সালে দেশের বনভূমির যে তালিকা করা হয়, তাতেও ঝিলংজা মৌজা বনভূমি
হিসাবে আছে। বরাদ্দ দেয়া জমির ৪০০ একর পাহাড় ও ৩০০ একর ছড়া বা ঝরনা। সেখানে
অনেক দূর্লভ প্রজাতিসহ ৫৮ প্রজাতির বৃক্ষরাজি রয়েছে। বিভিন্ন জীববৈচিত্রেও
বনটি সুসজ্জিত। কিন্তু বন বিভাগ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক
মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির আপত্তি উপেক্ষা করে বন বিভাগের আওতাধীন
এ জমিকে ভূমি মন্ত্রণালয় বেআইনিভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ইজারা দিয়েছে।
রক্ষিত বন ও পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাকে স্থাপনা নির্মাণের জন্য বরাদ্দ
দেয়া দেশের প্রচলিত আইনে অবৈধ। কিন্তু ইজারা দেয়ার উদ্দেশ্যে দেশের অন্যতম
জীববৈচিত্রপূর্ণ এ বনভূমিকে অকৃষি খাসজমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। বরাদ্দ দেয়া
জমির বাজারমূল্য ৪ হাজার ৮০০ কোটি হলেও দাম ধরা হয়েছে মাত্র ১ লাখ টাকা।
বনভূমি
রক্ষার বদলে স্থাপনা নির্মাণের জন্য বনভূমি ইজারা দেয়া হচ্ছে। পাহাড়
বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। এভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন
করে তোলা হয়েছে। উন্নয়নের নামে পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করা কোনভাবেই
মেনে নেয়া যায় না। জনপ্রশাসনের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিকে আমরা সমর্থন করি।
তবে এ জায়গায় এটা হওয়ার কোন সুযোগ নাই কারণ এটা বিধিবিধান, নিয়মকানুন
এমনকি সংবিধান পরিপন্থী। বলে রাখা ভাল সাভারে পিএটিসি, শাহবাগে ঈঙঞঅ এবং
ইস্কাটনে ট্রেনিং সেন্টারসহ অনেক ট্রেনিং সেন্টার থাকার পরেও আবার
প্রশিক্ষণ একাডেমির কোন প্রয়োজন আছে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করে না। শুধুমাত্র
সারদা পুলিশ ট্রেনিং একাডেমি নিয়ে পুলিশ বিভাগ সন্তুষ্ট বা বিদেশে ও
জাতিসংঘে সুনাম অর্জন করেছে, সেরূপ জনপ্রশাসনের অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান থাকার
পরও দুটি পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ব্যবহার করেও আন্তর্জাতিক মানের কর্মকর্তা
তৈরিতে সক্ষম হয় নাই। তাই আসুন পরিবেশ রক্ষায় সবাই উদ্যোগী হই। জনপ্রশাসনের
প্রশিক্ষণের যে সকল কেন্দ্রসমূহ আছে সেগুলোকে অধিক মানোন্নয়ন ঘটিয়ে গণমুখী
জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হই। অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারনা বড় বড়
কর্মকর্তাদের পর্যটনের কাজেই প্রশিক্ষণের চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হবে এ
প্রশিক্ষনের নামে গঠিতব্য পরিবেশ বিধ্বংশী একাডেমি।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল