ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রেলওয়ের গলার কাঁটা ডেমু, ২০ ট্রেনের ১৭টিই বিকল
Published : Thursday, 23 September, 2021 at 12:00 AM
যাত্রীসেবার মান বাড়তে ২০১৩ সালে ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন কিনেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। ব্যয় হয়েছিল ৬৫৪ কোটি টাকা। নয় বছরের মাথায় এখন সচল মাত্র তিনটি। বাকি ১৭ সেট ডেমু ট্রেন দীর্ঘদিন ধরে ওয়ার্কশপে বিকল হয়ে পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় এসব ট্রেন সচলও করতে পারছে না রেলওয়ে।
এদিকে এখন যে তিন সেট ডেমু সচল আছে সেগুলোতেও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। যাত্রীদের অভিযোগ, এসব ট্রেন প্রায়ই বিকল হয়ে যায়। অন্য ট্রেন দিয়ে টেনে ওয়ার্কশপে নিতে হয়। ফলে এসব ট্রেনে চলাচলকালী যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১১ সালে ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনতে চীনের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর সঙ্গে শুল্ক-কর এবং ৩০ জন কর্মকর্তার বিদেশে ভ্রমণ-ভাতার খরচ যোগ হয়। এতে এই খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকায়। পরে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই সেট ট্রেন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর ঢাকা-টঙ্গী, ঢাকা-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, কমলাপুর-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী-লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-পঞ্চগর রুটে বাকি ট্রেনগুলো চালু হয়।
এসব ট্রেন মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের স্বল্প দূরত্বে (২০ কিলোমিটার) যাতায়াতের জন্য কেনা হয়েছিল। অথচ অন্য প্রতিটি রুট গড়ে ৯০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। ফলে উদ্বোধনের কিছুদিনের মধ্যেই একের পর এক ট্রেন বিকল হতে শুরু করে।
অথচ চীন থেকে কেনা এসব ডেমু ট্রেন সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির। প্রতিটি ট্রেনের মেয়াদকাল ছিল ৩০ বছর করে। কিন্তু উদ্বোধনের কিছুদিন পর এক এক করে ট্রেনগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন দেশে এই ধরনের ট্রেন সচলে ওয়ার্কশপ ও যন্ত্রপাতি নেই। ফলে ট্রেন নষ্ট হলে সারানোর ব্যবস্থাও নেই। এখন এই ডেমু ট্রেনগুলো রেলওয়ের গলার কাঁটা।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চীনের তৈরি ডেমু ট্রেন কেনার প্রকল্প সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। নীতিগত কিছু ভুলের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ডেমু ট্রেনের দুই দিক দিয়ে দুটি ইঞ্জিন এবং মাঝখানে একটি বগি থাকে। বগির পাশাপাশি ইঞ্জিন অংশেও যাত্রী বহন করা যায়। প্রতিটি ডেমুতে ১৪৯ জন বসে এবং ১৫১ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু যখন ডেমুগুলো উদ্বোধন করা হয়, তখন প্রতিটি ডেমুতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী যাতায়াত শুরু করে। এর মধ্যে স্বল্প দূরত্বের এসব ট্রেন এক থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে যাত্রী বহন করতে থাকে। মূলত এ কারণেই ট্রেনগুলো অল্পদিনে বিকল হয়ে পড়ে। অন্যথায় এ ধরনের ট্রেনের ইঞ্জিনে পাঁচ বছরের আগে হাত দেওয়া লাগে না। মেরামত করে ২০ থেকে ২৫ বছর চালানো যায়।
কমলাপুর রেল স্টেশন সংলগ্ন ডেমু ট্রেনের ওয়ার্কশপ। মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় সরেজমিনে দেখা যায়, ওয়ার্কশপের ভেতর এবং বাইরে বিকল হয়ে পড়ে আছে ১০টি ডেমু ট্রেন। এসব ট্রেনের অধিকাংশের দরজা-জানালা ভাঙা। আসনের ওপর কয়েক স্তর ধুলাবালির আবরণ পড়েছে। কয়েকটি ট্রেনে লতাপাতা জন্মাচ্ছে। কিন্তু এসব ট্রেন ঠিক করতে কোনো মিস্ত্রিকে কাজ করতে দেখা যায়নি।
এদিন দুপুর আড়াইটায় কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরগামী দুটি ডেমু ট্রেন। এসব ট্রেনে নির্দিষ্ট গন্তব্যের যাত্রীরা ওঠেন। কিন্তু ট্রেনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ফ্যান নষ্ট। এছাড়া জানালাগুলো খুবই ছোট। বাইরে থেকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ট্রেনে ঢোকে না। ফলে গরমে অনেক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে ২টা ৪৫ মিনিটে ট্রেন দুটি স্টেশন ছেড়ে যায়।
নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার জন্য ট্রেনে ওঠেন ফতুল্লার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. সোহাগ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এই ট্রেনে যাতায়াতে সময় এবং ভাড়া কম লাগে। তাই নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর আসা-যাওয়ায় ট্রেনেই যাতায়াত করি। কিন্তু যেদিন ডেমু ট্রেনে উঠি, সেদিন গরমে হাঁসফাঁস লাগে। আসন খালি থাকলেও ভেতরে বসি না। আলো-বাতাসের জন্য দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করি।
গাজীপুরের টঙ্গীর বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। চার বছরের এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ডেমুতে উঠেছেন তিনি। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত গরমে তারা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। হাবিবুর বলেন, এখন কমলাপুর থেকে গাজীপুর বাসে যাতায়াত করতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ট্রেনে এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া যায়। তাই গরমে কষ্ট হলেও ট্রেনে যাতায়াত করি। তবে যাত্রীসেবার নামে রেলওয়ের এই তামাশা বন্ধ করা জরুরি।
কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার জাগো নিউজকে জানান, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর রুটে যে দুটি ট্রেন চলাচল করে সেগুলো ভোর সাড়ে ৫টা ও দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে কমলাপুর ছেড়ে যায়। এসময় ডেমুতে যাত্রী সংখ্যা কম থাকে। ফলে চলাচলে তেমন সমস্যা হয় না।
তবে ভিন্ন কথা বলেন নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর রুটের বুকিং সহকারী শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, দুপুরে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ডেমুতে গড়ে ৩শ করে যাত্রী পরিবহন করা হয়। ভোরে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকে। এছাড়া ডেমুতে ত্রুটি বা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। তখন ট্রেনের টিকিট ফেরত নেওয়া হয়।
রেলওয়ের হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ডেমু দিয়ে যাত্রী পরিবহন করে প্রায় ৩০ কোটি টাকা আয় করেছে রেলওয়ে। কিন্তু ডেমু ট্রেন পরিচালনায় (জ্বালানি ও স্টাফদের বেতন) প্রায় একই পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ, ডেমুর আয়-ব্যয় সমান। কিন্তু যে ৬৫৪ কোটি টাকা খরচ করে এই ট্রেন কেনা হয়েছে, সেই টাকা পুরোটাই জলে গেছে। অথচ এই পরিমাণ টাকা দিয়ে সাধারণ ট্রেনের ১২০টি এসি বগি কেনা যেতো। প্রতিটি এসি বগি থেকে বছরে গড়ে আড়াই কোটি টাকা আয় হয়।
ডেমু ট্রেনগুলো মেরামতের দায়িত্বে রয়েছেন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। এসব ট্রেন মেরামতের বিষয়ে জানতে সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি তা কেটে দেন।
মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় তার দপ্তরে গিয়ে দেখা করতে চাইলে তিনি জাগো নিউজের এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ।’
সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টায় ডেমুর বিষয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পরদিন তার কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলতে বলেন। সে অনুযায়ী মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তার অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল আলম জানান, রেলমন্ত্রী দাপ্তরিক কাজে কক্সবাজার গেছেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ডেমু ট্রেন যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। অথচ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ শহরে সার্কুলার ট্রেন হিসেবে ডেমু যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে পারতো।
তিনি বলেন, রেলওয়ের কর্মকর্তারা এই ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করেননি। তাই ট্রেনগুলো দেশে আনার পর দেখা গেলো স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের সিঁড়ি আড়াই ফুট উঁচু। এতে নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের ওঠা-নামায় সমস্যা হয়। ট্রেনের ভেতরের কাঠামোও যাত্রীবান্ধব ছিল না। ফলে ডেমু জনপ্রিয়তার বদলে তার চাহিদা নষ্ট করেছে।