প্রভাষ আমিন ||
একসময়
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন মাশরাফি বিন মোর্তজা। জাতীয়
ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়কের একদা জনপ্রিয়তাকে নিছক সবচেয়ে বেশি বললেও
কম বলা হয়। আসলে তার জনপ্রিয়তা ছিল সর্বগ্রাসী। ভালো খেললেও সাকিব-তামিমদের
সমালোচনাও কম ছিল না। বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার মোহাম্মদ আশরাফুল তো
ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জাতীয় শত্রু হয়ে গেছেন। কিন্তু একটা সময়
ছিল, যখন মাশরাফির কোনও শত্রু বা সমালোচক ছিল না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি
নির্বিশেষে সবাই ছিলেন মাশরাফির ভক্ত। নেতৃত্বে, পারফরম্যান্সে, মানবিকতায়,
দেশপ্রেমে মাশরাফি ছিলেন সত্যিকারের আইডল। তার গুণগুলো নিশ্চয়ই আগের মতোই
আছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা আর আগের জায়গায় নেই। একটি দলে যোগ দিয়ে এমপি হতে
গিয়ে তিনি জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছেন।
মাশরাফি যত ভালোই হোন, আওয়ামী লীগ
বিরোধীরা কিছুতেই আর তাকে পছন্দ করবে না। তাছাড়া গত বিশ্বকাপের
পারফরম্যান্স, অবসর নিয়ে নানা নাটকীয়তায়ও মাশরাফির জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে।
তবে যা শুনি, নড়াইলের এমপি হিসেবে তিনি সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে থাকেন।
প্রচলিত রাজনীতিবিদদের মতো নন তিনি। জনপ্রিয়তায় ধস নামলেও সেভাবে কোনও
বিতর্কে কখনও জড়ায়নি মাশরাফির নাম। কিন্তু তার সারা জীবনের নিষ্কলঙ্ক
ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক লেপন করে দিয়েছে ই-অরেঞ্জ। এই ‘হায় হায়’ ই-কমার্স
প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন মাশরাফি। কিন্তু সাধারণ জনগণের
১১০০ কোটি টাকা মেরে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে ই-অরেঞ্জ। দুই মালিক কারাগারে,
নেপথ্য মালিক ভারতের কারাগারে। কিন্তু মালিকদের আটকালেই তো সমস্যার সমাধান
হচ্ছে না। জনগণের ১১০০ কোটি টাকা কে ফেরত দেবে?
আর কাউকে না পেয়ে
ই-অরেঞ্জের প্রতারিত গ্রাহকরা মাশরাফির মিরপুরের বাসায় গিয়ে ভিড় করছেন।
অন্য কেউ হলে হয়তো দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু মানবিক মাশরাফি তা
করেননি। যদিও ই-অরেঞ্জের সঙ্গে তার চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়েছে আগেই, তবু তিনি
ই-অরেঞ্জের ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলছেন, পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছেন,
তাদের হয়ে নানা জায়গায় কথা বলছেন। কিন্তু মাশরাফি যত আন্তরিকই হোন, ১১০০
কোটি টাকা আদায় করে দেবেন কোত্থেকে? মাশরাফিও বুঝেছেন গ্রাহকরা এই টাকা আর
ফেরত পাবে না। একপর্যায়ে নাকি তিনি গ্রাহকদের টাকাটা ‘জানের সদকা’ হিসেবে
দিয়ে দিতে বলেছেন।
‘জানের সদকা’ প্রসঙ্গে পরে আসছি। কিন্তু ই-অরেঞ্জের
মেরে দেওয়া ১১০০ কোটি টাকার দায়িত্ব কে নেবে? অসহায় মাশরাফির হয়তো জানের
সদকা দিতে বলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। কিন্তু পুরো দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ
কি তার আছে। তিনি তো ই-অরেঞ্জের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন। কোনও
গ্রাহক যদি দাবি করেন, মাশরাফিকে দেখেই তিনি ই-অরেঞ্জে টাকা দিয়েছেন, তাহলে
মাশরাফি কীভাবে দায় এড়াবেন। মাশরাফি একা নন, এই হায় হায় কোম্পানিগুলো
তাদের প্রতি জনগণের আস্থা তৈরি করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের তারকাদের ফেসভ্যালু
ব্যবহার করে। সন্দেহভাজন আরেক কোম্পানি আলিশা মার্টের ব্র্যান্ড
অ্যাম্বাসেডর সাকিব আল হাসান। ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা তবু দুঃখের কথা বলার
জন্য মাশরাফির বাসা পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। আলিশা মার্টের কিছু হলে কেউ কি
সাকিবের দেখা পাবেন? ডুবন্ত কোম্পানি ইভ্যালির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর
ছিলেন তাহসান। জনপ্রিয় নায়িকা শবনম ফারিয়া, ফেসবুক সেলিব্রেটি আরিফ আর
হোসেন মোটা বেতনে ইভ্যালির উচ্চপদে চাকরি করেছেন। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই
তাহসান, শবনম বা আরিফকে দেখেও ইভ্যালিতে লগ্নি করে থাকতে পারেন। জনগণের
মেরে দেওয়া অর্থে এই হায় হায় কোম্পানিগুলো ক্রিকেট টিমের স্পন্সর করে,
সিনেমা বানায়, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়।
এভাবে তারা বাবল তৈরি করে এবং
আরও বেশি মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়। মাশরাফি বলছেন, ই-অরেঞ্জকে ব্যবসা
করার অনুমতি সরকার দিয়েছে। কোম্পানি ভালো না মন্দ সেটা দেখা সরকারের
দায়িত্ব। মাশরাফি ভুল বলেননি। কিন্তু মাশরাফি বা সাকিব বা তাহসান তো এসব
কোম্পানির স্রেফ মডেল নয়, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। সাধারণ মডেলরা হয়তো
কোম্পানির ভালোমন্দের দায় এড়াতে পারেন, কিন্তু ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডররা
নয়। এসব তারকা তাদের সারা জীবনের অর্জিত গুডউইল বিক্রি করেই ব্র্যান্ড
অ্যাম্বাসেডর হতে পেরেছেন। বিনিময়ে তারা নিশ্চয়ই মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়েছেন।
কারণ, এখানে তাদের নিজের নামেই উপস্থাপন করা হয়েছে, মডেল হিসেবে নয়।
সিগারেট কোম্পানিগুলোও বাংলাদেশে বৈধভাবে ব্যবসা করছে। মাশরাফি বা সাকিব কি
কোনও কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হবেন? ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে
হলে অবশ্যই তারকাদের যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। কোম্পানি ডুবে গেলে গা ঝাড়া
দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করার সুযোগ নেই।
এবার আসছি, ‘জানের সদকা’
প্রসঙ্গে। মানুষ বিপদে পড়লে জানের সদকা হিসেবে সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা-পয়সা
দান করেন। কিন্তু একজন মানুষ ‘জানের সদকা’ হিসেবে কত টাকা ছেড়ে দিতে পারেন?
জানই যদি না থাকে, সদকা দেবেন কোত্থেকে?
পত্রিকায় দেখলাম, সালাউদ্দিন
নামে একজন তার জীবনের সর্বস্ব এক করে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে ২ কোটি
টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু এখন তিনি পথের ফকির। জানের সদকা দিলে কি তার
জান থাকবে? এর আগে যুবক, ডেসটিনিতে সর্বস্ব হারিয়ে অনেকের আত্মহননের খবর
পত্রিকায় এসেছে। দুদিন আগে প্রথম আলো লিখেছে, গত ১৫ বছরে যুবক, ডেসটিনি,
ইউনিপেটু, এহসান গ্রুপ, ই-অরেঞ্জ, ইভ্যালি এবং বিভিন্ন সমবায় সমিতি মিলে
জনগণের ২১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। এবং এই ২১ হাজার কোটি টাকার এক
টাকাও কেউ ফেরত পাননি। এই ২১ হাজার কোটি টাকা তো সরাসরি জনগণের পকেট থেকে
গেছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা শেয়ারবাজারের
লুটপাট হিসাব করলে লোপাট হওয়া টাকার পরিমাণ লাখো কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই
টাকাও শেষ পর্যন্ত জনগণেরই। লোপাট হওয়ার পর আমরা সবাই মিলে শোরগোল তুলি।
কিন্তু ইভ্যালি বলুন আর ডেসটিনি, সবাই কিন্তু সবার চোখের সামনেই লুটপাটটা
করেছে। সবাইকেই এর দায় নিতে হবে। যেমন নিতে হবে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরদের,
ক্রিকেট টিমকে, বিজ্ঞাপন নেওয়া গণমাধ্যমকে।
তবে শেষ পর্যন্ত দায় বলুন
আর ব্যর্থতা বলুন, পুরোটাই সরকারের। এখন গ্রেফতার করে, বিচার করে দায় এড়ানো
যাবে না। ডেসটিনির রফিকুল আমিন বছরের পর বছর কারাগারে আছেন। সেখানে তিনি
অসুস্থতার অজুহাতে হাসপাতালে থাকেন, হাসপাতালে বসে জুমে ব্যবসায়িক মিটিং
করেন। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষ তো টাকা ফেরত পায়নি। ইভ্যালির রাসেল বা তার
স্ত্রীকে সারা জীবন কারাগারে রাখলেও তো প্রতারিত সাধারণ মানুষ টাকা ফেরত
পাবেন না।
জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু
যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটু, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের ক্ষেত্রে বারবার তারা জনগণের
মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কোনও কিছুর প্রথমবারে হয়তো সরকার বলতে
পারে, তারা বুঝতে পারেননি। কিন্তু বারবার নানা ফর্মে একই স্টাইলে প্রতারণা
করে মানুষের টাকা মেরে দেবে, আর সরকার বসে বসে বক্তৃতা দেবে; এটা হতে পারে
না। ইভ্যালি নিয়ে তো এক বছর ধরেই ফিসফাস চলছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক তো একবার
তাদের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে এক মাস পর আবার ছেড়েও দিয়েছিল। ব্যাংক
অ্যাকাউন্ট ছেড়ে দেওয়া মানে তো তাদের গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া।
এই দায় তো
বাংলাদেশ ব্যাংককে নিতেই হবে। দায়িত্ব নিলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা
দিতেই হবে। নইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীলরা
দায়িত্ব ছেড়ে দিন। একটি দেশে সুশাসন থাকলে, আইনের শাসন থাকলে দিনেদুপুরে
এমন লুটপাট চলতে পারে না। প্রতারকদের বিচার চলুক, শাস্তি হোক; পাশাপাশি
যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটু, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো হায় হায় কোম্পানির সব
স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে আনুপাতিক হারে হলেও জনগণের টাকা ফিরিয়ে
দেওয়া হোক। ২১ হাজার কোটি টাকা ‘জানের সদকা’ দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ