আবুল কাশেম হৃদয় ||
লাগেজ
নিয়ে আমেরিকা যাওয়ার জন্য কুমিল্লা থেকে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই তখন
আমার হাতে নেই পাসপোর্ট। ভিসা তো অনেক দূরের খবর। শুধু মোবাইলে একটি মেসেজ
এসেছে ‘ইউর ডকুমেন্ট রেডি ফর কালেকশন’। ভিসার জন্য আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে
আবেদন করে সাক্ষাতকার দিয়েছি। তারা আমার পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে ২০ দিনের
বেশি হলো। ভিসা চাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৪তম
সাধারণ অধিবেশনে অংশ নেয়া। ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন, সেখানে যাওয়াই আমার লক্ষ্য আর ২৫
সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় আমাকে মেসেজ দেওয়া হয়েছে। যদি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে
দেখি আমাকে ভিসা দেওয়া হয়েছে তাহলে আমার হাতে থাকবে আর এক দিন। একদিন পরে
আমেরিকায় গেলে আর প্রবেশ করতে নাও দিতে পারে। সেসব চিন্তা থেকে লাগেজ রেডি
করে গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম। যদি পাসপোর্টে ভিসা থাকে তাহলে সেখান থেকেই
আমেরিকা রওনা দিবো। যদিও আমার হাতে কোন বিমানের টিকেট নেই। কিন্তু নানান
দেশ ভ্রমণে আমার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো হয়েছে। কিভাবে বিমানের টিকিট কিনতে হবে
না হবে তার সবই আমার জানা।
সাহস করে ২৫ সেপ্টেম্বর ১১টায় কুমিল্লা
থেকে রওনা হয়ে বেলা আড়াইটায় ঢাকার গুলশানের ডেলটা টাওয়ারে ভিএফএস অফিসে
পৌঁছালাম। হার্টবিট তখন অনেক বেশি। লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট হাতে নিয়েই
দেখলাম পাতা ভারি আছে। মানে ভিসা দিয়েছে। আনন্দের সাথে উৎকণ্ঠও তখন চরমে।
হাতে সত্যিই আর একদিন আছে। মানে আজকেই বিমান ধরতে হবে। ঘনিষ্ট একজনকে ফোনে
বললাম। তিনি এমিরাটস, কাতার, তার্কিশ বিমানের ওয়েবসাইট সার্চ করে জানালেন
আজকে কাতার এয়ারওয়েজে সিট খালি আছে কিন্তু বিকাল ৫টার মধ্যে বিমান বন্দরে
চেকইন করতে হবে। আর কোন বিমানে সিট নেই। আমি তখন গুলশানে। গাড়ির চালককে
বললাম এয়ারপোর্টের দিকে যাও। আর ঘনিষ্ঠজনকে বললাম টিকেটের টাকা দেশে এসে
দিবো আমাকে টিকেট কনফার্ম করে ইমেইলে দেন। তিনি বারবার জিজ্ঞাসা করছেন
আপনি কি বিমানবন্দরে যেতে পারবেন, রেডি হবেন না? ইত্যাদি। আমি বললাম- আমি
লাগেজ নিয়েই এসেছি। তিনি বললেন-ঠিক আছে আপনি যেতে থাকেন আমি টিকেট কনফার্ম
করছি। বিমান বন্দরে পৌঁছে গাড়ি পার্কিং করার সময় টিকেট আসে। টিকেট নিয়ে
সোজা কাতার এয়ারওয়েজের চেকইনে চলে যাই। লাগেজ বুকিং দিয়ে বোডিং পাস নিয়ে
বুঝতে পারি ক্ষুধা লেগেছে। সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি। বিমানবন্দর থেকে বের
হয়ে নীচে হোটেলে খাবার খেয়ে আবার বিমানবন্দরে ঢুকে ইমিগ্রেশন করে বিমানে
উঠার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। সাড়ে ৭টায় বিমান ছাড়বে। বিমানে উঠে মনে
হলো-আমেরিকায় তো যাচ্ছি, কিন্তু সেখানে তো কাউকে বলি নি। থাকবো কোথায়?
বিমান বন্দর থেকে বের হলে কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? ফোন কিনবো কিভাবে?
নানান প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। বিমানে উঠার পর মোবাইলে ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক
চলে গেছে। কাউকে বলাও সম্ভব হয় নি। কিন্তু ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আছে বলে জানি
বিমান আকাশে উঠার পর ১০ এমবি ডাটা ফ্রি পাওয়া যায়। কল করা যায় টেক্সটও করা
যায়। সে ভরসায় বিমানে বসে একটা ঘুম দিলাম। ফ্লাইট এটেনডেন্ট ঘুম থেকে তুলে
খাবার খেতে দিলো। মোবাইল ডাটা ব্যবহার করে নিউইয়র্কে একজনকে বললাম আমার
থাকার জন্য কোন হোটেল ঠিক করে দিতে। নিউইয়র্কে জ্যাকসন হাইটসের কোন একটি
হোটেল হলে চলবে। এর মধ্যে মোবাইল ডাটা শেষ হয়ে যায়। প্লাটিম (ভিসা) কার্ডও
একটিভ না করায় বিমানে ডাটা কিনতে পারি নি। ফলে টেনশন বাড়ে। কাতারের দোহা
বিমান বন্দরে ট্রানজিটের সময় আবার যোগাযোগ করি নিউইয়র্কে। বলি হোটেল না
পাওয়া গেলেও আমাকে যেন একটি ঠিকানা বা পোস্ট কোড দেয় যেখানে গিয়ে আমি লাগেজ
রাখতে পারবো। হোটেল আমি নিজেই খুঁজে নিবো। এর মধ্যে নিউইয়র্কের জেএফকে
বিমানবন্দরের উদ্দেশ্য যাওয়ার জন্য বিমানে উঠতে যাওয়ার ডাক পড়ে। লাইনে যখন
ভিসা চেক করা হচ্ছিল তখন দুজন ফ্লাইট এটেনডেন্ট এসে ফুল হাতে ধরিয়ে দিয়ে
আমাকে বললেন-‘শুভ জন্মদিন’। আমি তো একেবারেই বিস্মিত। নিজেই নিজের
জন্মদিনের কথা ভুলে গেছি। কিন্তু ফ্লাইট এটেনডেন্ট ডাটা দেখে আমাকে
শুভেচ্ছা জানিয়ে মনে করিয়ে দিলো। তাদের শুভেচ্ছায় আমার দীর্ঘ ক্লান্তি
অনেকটা ঘুছে গেলো। বিমানে বসে টেনশন হচ্ছিল। নিউইয়র্কের বিমানে তো উঠলাম।
কিন্তু আমার থাকার জায়গা? এর মধ্যে একটা মেসেজ এলো। একটা ঠিকানা দেওয়া
হলো-যেখানে আমি লাগেজ রাখতে পারবো। আমার এতেই যেন স্বস্তি। লাগেজ নিয়ে
হোটেল খোঁজার ঝুঁকিটা অন্তত কমলো। যেহেতু ইংরেজি ভাষাভাষির দেশ, সেহেতু
ছোটখাটো ইংরেজি বলে ট্যাক্সি নিয়ে ঠিকানা পর্যন্ত যেতে পারবো। এর মধ্যে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের একজনের সাথে কথা হলো। তিনি বললেন, হোটেল
পর্যন্ত আসতে পারলে থাকার ব্যবস্থা হবে। জন্মদিনের দিন নিউইয়র্কের জেএফকে
বিমান বন্দরে নামার পর আমার সমান উচ্চতার এক প্রশিক্ষিত কুকুর আমার দেহ
তল্লাশি করলো। কুকুর চুপচাপ, বুঝলাম কোন ঝামেলা নেই। গুড মর্নিং বলে
ইমিগ্রেশন অফিসারের হাতে পাসপোর্ট দিতেই বললো- ওয়ার আর ইউ গোয়িং? বললাম-
ইউএন জেনারেল অ্যাসেম্বিলি। তিনি পাসপোর্টে সিল দিয়ে বললেন-নো নো। আমি তো
ভয়ে শেষ। সবকিছু ঠিক থাকলেও ইমিগ্রেশন অফিসার চাইলে আমাকে ফেরত দিতে পারে।
আমি ভয়ে তার দিকে তাকাতেই বললেন-ওয়েলকাম অ্যামেরিকা। ঐ অফিসারকে থ্যাঙ্ক ইউ
ফর ইউর নাইস কোঅপারেশন বলে ইমিগ্রেশন শেষে বাইরে এসে দেখি আমার লাগেজ
বেল্টে ঘুরছে। তুলে নিয়ে, মোবাইল সিম কিনে চালু করে বিমান বন্দরের বাইরে
এসে লাইনে থাকা ট্যাক্সিকে বললাম-আই ওয়ান্ট টু গো জ্যাকসন হাইটস। তিনি
বলেন-চলেন। আমি অবাক হলাম। চালক আমাকে বাংলায় জবাব দিলেন। ট্যাক্সিতে কথা
বলার পর জানলাম তার বাড়ি কুমিল্লায়! টমসনব্রিজের তার নাকি শ্বশুর বাড়ি।
কথায় কথায় তিনি আমাকে জ্যাকসন হাইটস নিয়ে এলেন। তবে নতুন পেয়ে যথারীতি একটু
ঘুরিয়ে আনলেন। আমার নির্ধারিত ঠিকানা অনুযায়ী আমাকে নিচ্ছে কিনা তা আমি
গুগল ম্যাপে দেখছিলাম, কিন্তু তা তিনি বুঝতে পারেন নি। এক শ’ ডলার পূর্ণ
করে তবেই আমার ঠিকানায় থেমেছেন। যাঁর ঠিকানা আমাকে দেওয়া হয়েছে তাঁর সাথে
পরিচয় হতে হতেই তিনি বলে উঠলেন-আপনি তো আত্মীয়! আমি বললাম কিভাবে বললেন-
আপনার শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে। আমার আমায় পায় কে? নিউইয়র্কে থাকার বাকি কাজ
সব তিনিই করলেন। বিকালে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গিয়ে সাংবাদিকের
এ্যাক্রিডিটেশন কার্ড নিয়ে জাতিসংঘের ভবন ঘুরে দেখতে গিয়ে পেয়ে যাই মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী শীর্ষ কর্মকর্তাদের ও নেতাদের। সন্ধ্যায় অংশ নেই
প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনায়।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কুমিল্লার কাগজ