ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
দল আছে নেতা নেই!
Published : Sunday, 26 September, 2021 at 12:00 AM
চিররঞ্জন সরকার ||
বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাকুক না কেন, রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। দেশে নিবন্ধিত দল আছে প্রায় ৪১টি। আর নিবন্ধন ছাড়া দলের সংখ্যা কত আছে, সেটা কেউ জানে না। এর মধ্যেই সম্প্রতি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরও একটি রাজনৈতিক দল গড়েছেন। নুরুল হক মনে করেন, ‘দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার কারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা নিশ্চিত করতে চাই, তবে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দরকার।’ আমাদের দেশে গত তিন দশকে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ বহু রথী-মহারথী দল গঠনের চেষ্টা করেছেন। দল গঠনের আগে-পরে অনেক ভাল ভাল কথা বলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দলগুলো এখন সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দল হয়েই রয়েছে। এমনকি বিএনপি, জাতীয় পার্টির মতো বড় দলগুলোও ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে।
আসলে আমাদের দেশে এখন দলগুলোর মধ্যে রাজনীতির চর্চা বা রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। একইসঙ্গে একথাও বলা ভাল যে, দলগুলোতে যথার্থ যোগ্য নেতাও নেই। নেতা তৈরি হচ্ছে না। দলগুলোর রাজনীতি চর্চার ধরনও খুব একটা স্বচ্ছ নয়। আগামীকাল যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের নাম পাল্টে বিএনপি রাখেন এবং তথাকথিত ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের’ নামে বিএনপি স্টাইলে রাজনীতি চর্চা শুরু করেন, তাহলে কি বিএনপি তাকে সমর্থন করবে? না, করবে না। কারণ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বিশ্বাস অথবা অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হলো কিনা সেটা তার বিরোধীতা করার ক্ষেত্রে কোনো মাপকাঠি নয়। বিএনপির কট্টর নেতাকর্মীসমর্থকদের একান্ত বিরোধীতার লক্ষ্য হলেন ব্যক্তি শেখ হাসিনা। অতএব তিনি তার দলের নাম যাই রাখুন, রাজনৈতিক অবস্থান যাই গ্রহণ করুন, তাতে কিছু যায় আসে না। বিএনপির একাগ্র মনোবাসনা হলো: যেকোনোভাবে শেখ হাসিনা যেন পরাজিত হন, অপমানিত হন এবং রাজনৈতিকভাবে হেনস্তার শিকার হন।
অর্থাৎ আমাদের রাজনীতিতে শাসক আসলে কোনো দল নয়, একজন ব্যক্তি। বিরোধীদের আক্রমণের, ঘৃণার লক্ষ্য কোনো শাসক দল নয়। নিছক একজন ইন্ডিভিজুয়াল। বিএনপি, জামায়াত, ড. কামাল, মাহমুদুর রহমান মান্নার দলগুলির লড়াই একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে ঘিরে একটি দেশের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে, একজন ব্যক্তির জয়-পরাজয় দেশের চর্চায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগকে যারা জেতাতে চান তারা কোনো দলকে ভোট দেন না। তারা আদতে শেখ হাসিনাকে জয়ী দেখতে চান। আওয়ামী লীগকে যারা হারাতে চান তারা আসলে শেখ হাসিনাকে পরাজিত দেখতে চান। দেশের রাজনীতির ভরকেন্দ্র হিসেবে এভাবে মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রাখা কীভাবে সম্ভব হয়ে উঠলে এটা প্রশ্ন নয়। সেই আলোচনা অনেক হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে হাজারো যুক্তিসহ। শেখ হাসিনাকে সমর্থন করা উচিত? নাকি বিরোধিতা করা সঙ্গত? সেটাও এখানে আলোচ্য নয়। ওটা যার যার গণতান্ত্রিক অধিকার ও বুদ্ধিবিবেচনা দিয়েই বিচার করা কাম্য।
প্রশ্ন হলো, এরকম আর কোনো নেতানেত্রী, তা যে দলেরই হোক, উঠে আসছেন না কেন? চারদিকে এত আধুনিকতা, এত ঝকঝকে প্রচারের ব্যবস্থা, এত সুযোগ, এত সমস্যা। তবুও দেশে আমরা শেখ হাসিনার মতো আর কোনো একক শক্তিশালী চরিত্রকে দেখতে পাচ্ছি না আর! কেন? কেন বিএনপি সমর্থকদের কাছে খালেদা জিয়া ছাড়া কোনো হাই প্রোফাইল নেতা নেই? কেন বিএনপির সমর্থকরা বিএনপি নামক দলকে সমর্থন করছেন? কোনো প্রভাবশালী নেতার জন্ম হচ্ছে না কেন? বিএনপির ক্ষেত্রেও ‘জিয়া’ নামক পদবির দরকার হচ্ছে কেন? কেন এখনও তারেক রহমানকেই দলের দায়িত্ব দেয়া হয়? কেন তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানকে বিকল্প নেতৃত্ব ভাবা হয়? কেন ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা আবদুল্লাহ আল নোমানদের ভাবা হয় না? অন্য যে কোনো কাউকেই তো প্রজেক্ট করা যায়? এমনকি আওয়ামী লীগেও শেখ হাসিনার বিকল্প আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
রাজনীতিতে কোনো একক ক্যারিশমার চরিত্র আসছে না। যাকে পছন্দ অথবা অপছন্দ যাই করি, প্রভাবটাকে অস্বীকার করতে পারি না। সেরকম কোনো উচ্চতার, মাপের নেতা কেন পাচ্ছি না? এর সামাজিক কারণটি কী? শুধু রাজনীতির আঙিনায় নয়। সাহিত্য, সঙ্গীত, সিনেমা কোথাও কোনো আইকনের জন্ম হচ্ছে না। যাকে নিয়ে গোটা সমাজ আলোচনা করতে পারে। এর প্রধান কারণ হল বাঙালি একক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আর কিছু করার সাহস পায় না। আমরা নিজেরাই বিশ্বাস করি না যে, এককভাবে আমি অনেক কিছু করতে পারি। একটা চেষ্টা করে দেখি না! এভাবে আর ভাবি না। অন্তরের শক্তির নিরিখে সকলেই আদতে অ্যাভারেজ তথা মানসিক শক্তিতে ক্ষুদ্র হয়ে গিয়েছি। আগে মাঝেমধ্যেই সিজনে সিজনে বাঙালির হুজুগ পেত। যেমন ডিসেম্বর ও মার্চ মাসে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ পায়। ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা পায়। বৈশাখে শাড়ি-পাঞ্জাবি আর পান্তা-ইলিশ পায়। এখন বাঙালির সারাবছর প্রতিবাদ পায়। এখন অসংখ্য ইস্যু কিন্তু প্রতিবাদ-আন্দোলন নেই। প্রতিবাদ থেকেই তো নেতার জন্ম হয়। এখন ফেসবুকে লেখা ছাড়া আর কোনো প্রতিবাদ আন্দোলন নেই, ফেসবুক সেলিব্রেটি ছাড়া কোনো সর্বজনগ্রাহ্য জনপ্রিয় নেতারও উত্থান ঘটছে না।
তোফায়েল, মতিয়া, ইনু, মেনন, সেলিমরা এসেছিলেন ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে। আজকের ছাত্র রাজনীতি বলে আদতে কিছুই নেই। যা আছে তা ঠকবাজি। এখন রাজনীতি ও ইস্যুর কোনো গভীরতা নেই। এই অগভীরতা এটা প্রমাণ করে আসলে আমাদের মধ্যে আর প্রকৃত আগুনই নেই। যে আগুনটা স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে এই সেদিন নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও ছিল। ভুল হোক ঠিক হোক সেদিনের ছাত্র-যুবরা নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আদর্শ সমাজ গঠনের স্বপ্নে ঝাঁপিয়েছিলেন। আজকের ছাত্রসমাজ শেষ কবে কৃষকদের জন্য মিছিল করেছে? কবে শ্রমিকদের জন্য রাস্তায় নেমেছে? কবে কর্মসংস্থানের দাবিতে আন্দোলন করেছে? আমরা এখন সর্বাগ্রে ঝাঁপাই অন্যকে অবজ্ঞা করার দিকে।
আমরা নিজেরা প্রতিদিন যে সংসার, পেশা, আড্ডা, ফেসবুক, প্রেম, টিভি, যে কাজগুলো করে থাকি তা আসলে আগের দিনেরই প্রায় পুনরাবৃত্তি। পরদিনও ওই কাজগুলিতেই ব্যাপৃত থাকি। এই স্বল্প আয়ুর জীবনে এমন কিছু খুব একটা করি না যাতে নিজের প্রতি আমাদের গর্ব হয়। আমাদের অহংকার আছে, দম্ভ আছে, আত্মাভিমান আছে। কিন্তু নিজের প্রতি নিজেদের কতজনের আন্তরিক শ্রদ্ধা আছে? নেই। কারণ নিজেকে ছাপিয়ে, অন্যকে ছাপিয়ে নিজের চেষ্টায় এমন কিছু হয়ে উঠতে পারি না যাতে আমাদের কেউ রোলমডেল করতে পারে। আমাদের কজনকে দেখে অন্য কেউ ভাববে হ্যাঁ ওকে অনুসরণ করা যায়? ওর অনুগামী হওয়া যায়! ভাববে না। কারণ ক্রমশই আমাদের আচরণে অন্যকে অপমান করে নিজেকে জয়ী প্রমাণের প্রবণতা প্রোথিত হয়েছে। নিজের অবস্থান, কর্মে আর আদর্শে বলীয়ান হয়ে জয়ী হওয়ার চেষ্টা নেই। সেটা কঠিন।
আমরা আজ স্থূল কথা আর কাজে চ্যাম্পিয়ন! নেতা বা নায়ক হওয়ার প্রধান শর্ত হলো অন্যরা আমাকে দেখে মুগ্ধ হবে। অন্যরা মনে করবে-আমার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আর কারও মধ্যে পাওয়া যাবে না। তাকে বিশ্বাস করা যায়। তার ওপর নির্ভর করা সম্ভব। তিনি আমাদের কথা বলেন। আর সর্বপরি পারলে তিনিই পারবেন। এমন কোনো নেতা আর দেশে আসছে না। কারণ আমাদের নিজেদের উপরই তো বিশ্বাস নেই যে আমার সত্যিই গুরুত্ব কতটা। সেই কারণেই এই সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রতিটি প্রতিবাদে আছি, প্রতিদিনের সুপ্রভাতে আছি, প্রতিদিনের রাজনীতিতে আছি, ক্রিকেট, ঈদ-আর ধর্মে আছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আছি। কিছু না কিছু বলছি। শেয়ার করছি। পোস্ট করছি। কারণ কী? কারণ হল একটি বহুল প্রচলিত ইংরেজি আপ্তবাক্য। বাক্যটির সংক্ষিপ্ত রূপ বেশি জনপ্রিয়। ফোমা। ‘ঋঙগঅ’। পুরো কথাটি হল ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট!’ অর্থাৎ আমাদের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে না তো? আমরা হারিয়ে যাচ্ছি না তো পরিচিতদের মন থেকে? আমাকে ভুলে যাচ্ছে না তো? আমারও কিছু বলার আছেৃ আমার কথার গুরুত্ব দাও সবাইৃ। এই তাড়নাকেই বলা হয় ফিয়ার অফ মিসিং আউট। এটা যদি গ্রাস করে তাহলে তো বুঝতে হবে আমাদের আত্মবিশ্বাস শূন্য। এরকম সমাজ থেকে নেতার জন্ম হবে কীভাবে? তাই হচ্ছেও না। নতুন এই যুগে দল আছে, নেতা নেই। ভিড়ের জয়গান আছে। ভিড়তন্ত্রে নেতা জন্মায় না। একক শক্তি নেই, দল আর ভিড়ের শক্তি তাই বাড়ছে। যেহেতু অনেকগুলো একের যোগফলেই ভিড় বা দল তৈরি হয়, তাই সেইসব দলের শক্তিতেও আন্তরিক প্রাণ নেই। আছে নেহাত দেহের শক্তি। যেটা অত্যন্ত স্থূল। প্রাণের শক্তির সহজাত আকর্ষণ আছে, দেহের শক্তির আছে নিছক বলের জোর। বল দিয়ে জোর খাটানো যায়, মন টানা যায় না।
লেখক: কলামিস্ট।