মো মেহেদী হাসান ||
এক.
বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-৭৫) ১৯৫২ সালের যে সময়ে চীন ভ্রমণ করেন সে সময়ে
নয়াচীনের বয়স মাত্র ৩ বছর। তাঁর নিজেরও বয়স মাত্র ৩২ বছর। তখনো তিনি
বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন নি। ১৯৫০-এর মার্চ থেকে টানা দুবছরের মতো জেলে
কাটিয়েছেন। মুক্তি পাওয়ার পরপরই এ বছর পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন। এ সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ,
বঙ্গবন্ধুর জন্য যেমন, পূর্ব-বাংলার রাজনীতির জন্যও; এমন কি চীনের জন্যও।
কারণ মাত্র তিন বছরের মতো হয়েছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শেষ করে একটি নতুন
কাঠামোয় দেশ শুরু করেছেন মাও সে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬); এটাকে বঙ্গবন্ধু ‘নয়াচীন’
বলেছেন। ১৯৫২ সালের অক্টোবরে ‘এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি
সম্মেলনে’ পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চীন ভ্রমণ করেন তিনি।
চীনে তখন মাত্র জাতীয়তাবাদী চিয়ান কাইশেকের (১৮৮৭-১৯৭৫) সরকারকে উৎখাত করে
মাও-সে তুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এসময়টাতে ভ্রমণকালে নিবিড়ভাবে চীনকে দেখেছেন, পরিবর্তনশীলতার চেহারাটা মনে
রেখেছেন, এবং দুবছর পর যখন জেলে গেছেন তখন স্মৃতি থেকে তিনি লিখেছেন
‘আমার দেখা নয়াচীন’। আমরা এ গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ বলছি এ জন্যে যে বঙ্গবন্ধু
নিজেই বলেছেন, “যে দলটির নেতা পীর মানকী শরীফ. খান গোলাম মহম্মদ খান
লুন্দখোর, সিন্ধুর জি এম সৈয়দ, ইলিয়াস, আমি ও আরও অনেকে — বলতে পারেন
নন-কম্যুনিস্ট দল [রহমান (২০২০ :) ]।” কাজেই এ বইতে যে বয়ান তৈরি হয়েছে
সেটা একজন নন-কম্যুনিস্ট জাতীয়তাবাদীর চোখে দেখা। অন্যত্র বলছেন, ‘আমরা
আওয়ামীলীগের লোক—সংখ্যায় বেশি হয়ে গেলাম; কম্যুনিস্টরা আমাদের
‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে থাকে,; আর মুসলিম লীগাররা কম্যুনিস্ট ভাবাপন্ন বলে
গালমন্দ করে থাকে [রহমান (২০২০ : ২৫) ]।” এ মন্তব্যগুলো বঙ্গবন্ধুর
রাজনৈতিক দর্শনের পরিচয়ও তুলে ধরে। একদিকে তিনি ‘নন-কমিউনিস্ট’,
জাতীয়তাবাদী অন্যদিকে ‘কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন’ একজন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত
হন। এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখবো, চীন ভ্রমণে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে এ
পরিচয়ের নানাদিক যেন ফুটে ওঠে। তবে বঙ্গবন্ধু একটু সতর্কও করেছেন পাঠকদের
যেমন, “এখানে একটা বিষয় আলোচনা করা দরকার, চীনা শান্তি কমিটি ও সরকার ঠিক
বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমরা পাকিস্তান থেকে যারা গিয়াছি, তারা কম্যুনিস্ট না
এবং কম্যুনিস্ট ভাবাপন্নও না। অনেকে এর মধ্যে কম্যুনিস্ট বিরোধীও আছেন। তাই
বোধ হয় প্রাণ খুলে আমাদের সাথে আলাপ করছেন না অনেকেই [রহমান (২০২০ :
৭৫)]।” এ ধরনের বহুবিধ এবং বহুমখি অনেক সময় পরস্পরবিরোধী পরিচয়ের দিকটা
মাথায় নিয়ে এ গ্রন্থ পাঠ করতে হবে। এতে একটা বড় সুবিধা পাওয়া যায় সেটা হলো
বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গির বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ , যা আমাদের ভ্রমণকাহিনির মধ্য
দিয়ে চীন সম্পর্কে একটি বিকল্প বয়ান তৈরি করে।
সাধারণভাবে প্রথাগত
ভ্রমণকাহিনিতে প্রকৃতি, ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান আর কিঞ্চিৎ মানুষ
প্রাধান্য পায়। জে এ কুডন ‘ট্রাভেল বুক” সম্পর্কে বলেন যে, নিয়মিত লেখকরা
অনিয়মিত ভাবে কিছু ভ্রমণ কাহিনি লিখে থাকেন। তবে কূটনীতিক, ধর্মপ্রচারক,
ভাড়াটে যোদ্ধা, অভিযান-পরিচালনাকারী, নাবিক এবং আবিষ্কারক — এঁরাই প্রধানত
ভ্রমণ কাহিনি লিখে থাকেন। বঙ্গবন্ধুকে আমরা এ তালিকায় আবিষ্কারকের
ভূমিকায় পাই। কুডন আরও বলেন যে, সাহিত্যের এ শাখাটি কোনো এলাকায়
অস্থায়ীভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তির চোখে দেখা অভিযান আর আবিষ্কারের বিবরণ
তুলে ধরে [(ঈঁফফড়হ ২০১৩: ৭৩৬ )]। একজন বিদেশির চোখে একটি নতুন ভূমির পরিচয়
তুলে ধরার কথা বলা হলেও এ গ্রন্থে আমরা প্রথাগত ভ্রমণের বিবরণ পাবো না।
বরং এমন এক রাজনীতিককে পাবো যিনি একটি নতুন ব্যবস্থার নানা দিক দেখছেন,
মুগ্ধ হচ্ছেন, প্রয়োজনে সমালোচনা করছেন আর নিজ দেশে এমন ব্যবস্থাপনার
অভাবের জন্য দুঃখ করছেন। হয়তো স্বপ্ন দেখছেন তেমন কিছু কিছু করার । ভেতরের
অনুপ্রেরণাটা আমরা বলবো দেশপ্রেমের। একটা দেশ দেখার আনন্দ তাঁকে নিজ দেশের
প্রতি আরও দায়িত্বশীল ও কর্মতৎপর করে তুলছে যেন।
দুই.
একজন
জাতীয়তাবাদী নেতার দৃষ্টিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি কমিউনিস্ট সরকার কেমন —
তার একটা দুর্দান্ত রূপ পাওয়া যাচ্ছে এ রচনায়। সাধারণ অর্থে চীন সম্পর্কে
আমরা যে বিবরণ পাই, অর্থাৎ চীনকে আমরা যেভাবে জানি এবং আমাদের চৈতন্যে
চীনের যে ছবি মূর্ত হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর বিবরণ সে ছবির একটা বিকল্প বয়ান
উপস্থাপন করে। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না। সে কথা তিনি বারবার বলেছেন। তবে যে
চীন দেখেছেন সে চীনকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে দ্বিধা করেন নি। এটাই এ
ভ্রমণ-কাহিনির মূল সম্পদ। আমরা পড়তে গিয়ে বুঝতে পারি একটি সাধারণ ভ্রমণ
কাহিনিতে জোর পায় প্রকৃতি, ব্যক্তিগত উপভোগের বিষয়। কিন্তু এ ভ্রমণকাহিনিতে
দেখছি জোর পড়েছে চীনের আর্থসামাজিক-বাস্তবতা ও রাজনীতি। সবচেয়ে বেশি জোর
পড়েছে অতি সাধারণ কৃষক-শ্রমিকের জীবন প্রণালী। ভ্রেমণকাহিনিতে দেখছি, তিনি
বারবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে চাইছেন নানাভাবে সেটা এ জন্যে যে এতে
তাদের জীবন তিনি বুঝতে পারবেন। সেটা তিনি উল্লেখও করেছেন। এটা অনন্য
সম্পদ। তিনি ভ্রমণে গেছেন শান্তি সম্মেলনে কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে
বলছেন : “ আমি দেখতে চাই কৃষির উন্নতি, শিল্পের উন্নতি, শিক্ষার উন্নতি,
সাধারণ মানুষের উন্নতি [রহমান (২০২০ : ৬৬)] ।” অর্থাৎ তিনি নিজেকে নবিশ করে
তুলছেন। শিখে আসতে চান অনেক কিছু, যে অভিজ্ঞতা তাঁর নিজ দেশে কাজে লাগবে।
তবে
ভ্রমণের শুরুতেই দুর্দশা দেখছি। সেটা বিদেশে নয়, নিজ দেশে। পূর্ব-বাংলা
আওয়ামীলীগের পাঁচজন নেতা যাবেন, কিন্তু ‘পাসপোর্ট’ নেই। সেটার অনুমতি
আনতে হয় করাচি থেকে। বঙ্গবন্ধু বলছেন, “করাচির হুকুম প্রয়োজন। তাহা না হলে
তো পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ববাংলার কোন জলসাই হয় না [রহমান (২০২০ :
২০)]।” তিনি আরও বলছেন [রহমান (২০২০ : ২১)] :
আমাদের বিদেশে লিখতে হবে
পাকিস্তানি ব্রিটিশ নাগরিক। হায়রে স্বাধীনতা! বাড়ি ফিরতে প্রায় ছয়টা বেজে
গেল। টাকার প্রয়োজন, আমরাতো বড় লোক নই। আর পাকিস্তানে ফটকা ব্যবসা করতেও
আসি নাই যে নগদ টাকা থাকবে। ধার করতে হবে। জোগাড়ে লেগে গেলাম। ৃ যাহা হোক,
কোনো মতে কিছু জোগাড় করলাম, কাপড়-চোপড়ও কিছু জোগাড় হলো। দুই বৎসর, আড়াই
বৎসর জেলে থেকে কাপড় প্রায়ই ছোট হয়ে গেছে।
বিমান-ভ্রমণের শুরুতে
ব্রহ্মদেশের (বর্তমান মিয়ানমার) বিবরণ পাচ্ছি। সেখানে সামান্য উপস্থিতির
সময়টাতে তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, দেখছেন মায়ানমারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক
সংকট। জাতিগত সংকটের এ সমস্যা মায়ানমারে আজও যায় নি। কারেনদের সে সমস্যাও
আজও বিদ্যমান। বোঝা যায়, ১৯৫২ সালের সে বাস্তবতা এখনো জান্তব ও প্রাসঙ্গিক
হয়ে আছে। পাকিস্তানের রাষ্টদূতের জীবন-যাপনের চেহারাটা দেখতেও ভুলছেন না।
বলছেন, ‘রাষ্ট্রদূত অনেক জাঁকজমকের সঙ্গে থাকেন, বিরাট অফিস ও বহু কর্মচারী
তাঁকে সাহায্য করে। দেখে মনে হলো, যাদের টাকা দিয়া এত জাঁকঝমক তাদের
অবস্থা চিন্তা করলে ভালো হতো। তাদের ভাতও নাই, কাপড়ও নাই, থাকবার মতো
জায়গাও নাই। তারা কেউ না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে [রহমান (২০২০ : ২৩)]। “
বঙ্গবন্ধুর আজীবনের রাজনীতি ও ভাবনা ছিলো এদের নিয়ে। প্রান্তিকতাকে তিনি
এত গুরুত্ব দিচ্ছেন যে কেন্দ্রের এক বিলাসী কর্মকর্তার জীবন দেখে তাদের কথা
মনে পড়ে যাচ্ছে।
আমরা এ বাস্তবতা থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারি নি। এ
রচনায় আমরা বঙ্গবন্ধুর রসবোধের পরিচয়ও পাচ্ছি। চীনে ঢোকার আগে হংকং হয়ে
যাচ্ছেন। সে সময়ে রসবোধের পরিচয় পাচ্ছি হংকংয়ের একটি ঘটনায়। রাস্তায় একটা
১৬/১৭ বছরের মেয়ে আতাউর রহমানের কলারে ফুল লাগিয়ে দিতে অগ্রসর হয়।
বঙ্গবন্ধু সে সময়কার এ ঘটনা রসাত্মকভঙ্গিতে উপস্থাপন করছেন এভাবে: “হংকংয়ে
ফুল দেওয়াটা হলো ‘প্রেম নিবেদন’। ফুলটা গ্রহণ করলে ওরা মনে করবে আপনি তার
সাথে যেতে রাজি হয়েছেন। আপনাকে হাত ধরে সাথে করে ওদের জায়গায় নিয়ে যাবে।
বেচারি ভেবেছিল, আমাদের দলের নেতা মোটাসোটা, ভালো কাপড় পরা, গম্ভীর
প্রকৃতির —টাকা পয়সাও নিশ্চয়ই যথেষ্ট আছে,। ঠিকই ধরেছিল, বেচারি জানে না,
আমাদের নেতা নীরস ধর্মভীরু মানুষ, ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করেন আর একমাত্র
সহধর্মিণীকে প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবাসেন [রহমান (২০২০ : ২৮)]।” এ ঘটনার
প্রকাশভঙ্গির সরলতা একটা রসবোধের জায়গায় পৌঁছে দেয় তবে বর্ণনার চমৎকারিত্ব
পাঠকের চোখ এড়ায় না।
তিন.
নয়াচীনের শিক্ষা ব্যবস্থা দেখে বলছেন:
“একটা বিষয় দেখে সত্যি আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এক এক দেশে এক এক প্রকারের
‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি’ (‘প্রিভিলেজড ক্লাস’) আছে — যেমন, আমাদের দেশে
অর্থশালী জমিদাররা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’, অন্যদেশে ‘শিল্পপতিরা প্রিভিলেজ্ড
ক্লাস’; কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই ‘প্রিভিলেজ্ড ক্লাস’। এই
প্রিভিলেজড ক্লাসটা সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। নয়াচীন সরকারের
হুকুম, প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে ,
সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে।
যাদের দেবার ক্ষমতা নাই তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য
করবে। নতুন মানুষদের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন। ১৫/২০ বছর পরে এরা যখন
লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায়
গিয়ে দাঁড়াবে [রহমান (২০২০ : ৬০)]?” এ পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী সেকালে
পড়লে মনে হতে পারতো অতিরঞ্জন, মনে হতে পারতো এক মুগ্ধ পর্যটকের অতিরেক
ভাবনা , আর আজ আমরা চোখের সামনে চীনের বঙ্গবন্ধু কথিত ভাবনার বাস্তব
প্রতিফলন দেখছি। এতে বোঝা যায়, তাঁর ভবিষ্যত দেখার সামর্থ্য তথা
দূরদর্শিতার। আর শিক্ষাকে তিনি কীভাবে গুরুত্ব দিতেন তার পরিচয়ও এতে
প্রকাশিত।
বঙ্গবন্ধু পিকিং রেলস্টেশনে বিদায় কালে জাতীয় সরকারের
শিক্ষামন্ত্রী বোরহান শহীদকে পাচ্ছেন , যিনি চীনের মুসলমানদের পক্ষ থেকে
বই উপহার দিচ্ছেন, যাতে চীনের মুসলমানদের মসজিদ, স্কুল, কলেজের নানা
বিষয়ের ছবি আছে। এসব দেখে বঙ্গবনধুর মনে হচ্ছে, ‘এদেশের লোকের মনে অহংকার
নাই। সকলেই আপন করতে চায় [রহমান (২০২০ : ৬৪)]।’ চিয়াঙ কাইশেকের আমলে
আমেরিকানরা যে সব স্কুল চালাতো তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে সব স্কুলের ভাষা
মাধ্যম ছিলো ইংরেজি আর ‘সমস্ত মাস্টারই আমেরিকান ও ইংরেজ ছিল।’ বঙ্গবন্ধুর
দলের দোভাষী মিস লি জানাচ্ছেন, “সরকার সমস্ত ভার নিয়েছেন এবং জাতীয়করণ
করেছেন। এখন ২/১টা স্কুল আছে যেখানে শুধু ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হয়, আর সব
শিক্ষা মাতুভাষার মাধ্যমে করা হয়।” চীন ইংরেজি মাধ্যম বাদ দিয়ে সরাসরি
ম্যান্ডারিনকে শিক্ষার ভাষা-মাধ্যম হিসেবে চালু করে — সে সংবাদ পাচ্ছি। আজ
দেখা যাচ্ছে চীন ইংরেজি না শিখেও উন্নতি যে করা যায় তার নিদর্শন হয়ে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু লক্ষ করেছেন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইংরেজি জানেন কিন্তু
তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন চীনা ভাষায়। দোভাষী সেটা ইংরেজি করে তাদের বুঝিয়ে
দিচ্ছেন। এদেখে বঙ্গবন্ধু দেশ ও তার ভাষার চীনাদের মনোভাব বুঝে নিচ্ছেন।
আমাদের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশের ভাষা-চিন্তা ও পরিকল্পনার জন্যে একটা
নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে চীনাদের ভাষা-পরিকল্পনা। আমরা যে
জগাখিচুড়ি মাধ্যমে চলছি চীন সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
চার.
চীনের
কৃষি বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চীনে বিপ্লব হয়েছিলো
শ্রমিকদের দিয়ে নয়, প্রধানত কৃষক-সমাজের অংশ গ্রহণে। বঙ্গবন্ধু বলছেন :
“চীন সরকার কৃষির উন্নতি করছে— মাথাভারী ব্যবস্থার ভিতর দিয়া নয়, সাধারণ
কর্মীদের দিয়া। বিরাট ফার্ম সেখানে বীজ তৈয়ার করা হয় এবং দেশের ভিতর সে
ভালো বীজ ব্যবহার করার জন্য পাঠানো হয়। কৃষি শ্রমিকদের সুবিধাও অনেক।
আমাদের দেশে সরকারি কৃষি ফার্মগুলিতে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয় মাথাভারী
ব্যবস্থার ফলে [রহমান (২০২০ : ৬৬)]।” বঙ্গবন্ধু যখন চীন ভ্রমণ করেন তখন
মালিকানার বিষয়টা শতভাগ সরকার নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে নি সেটা বোঝা যায়। তবে
একটা শৃঙ্খলা যে এসেছে এটা বলা যায়। বঙ্গবন্ধু বলছেন, “ নয়াচীন সরকার
কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, ‘লাঙল যার জমি তার’ এই প্রথা
প্রবর্তনের মাধ্যমে। বড় বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব জমিহীন
কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দিলো। সত্যিকারের কৃষক জমির মালিক হলো। যে সমস্ত
অনাবাদি খাস জমি পড়ে ছিল, তাও ভাগ করে দিলো কৃষকদের মধ্যে। ৃ এখনও অনেক বড়
চাষি জমির মালিক আছে, তারা লোক রেখে চাষাবাদ করে। তবে প্রয়োজনের অধিক যে
জমি ছিল তা বাজেয়াপ্ত করে গরিব চাষিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে [রহমান
(২০২০ : ৮৯)]। ” চীন সরকারের কৃষিনীতির যে বর্ণনা এ গ্রন্থে পাই তাতে
চাষাবাদে যে গুরুত্ব ও জোর পড়েছে তা বোঝাই যায়। লেখক একখণ্ড অনাবাদি জমি
দেখেন নি; এমনকি আমাদের জানাচ্ছেন, রেললাইনের পাশের গর্তেও ফসলের আবাদ
চলেছে। আমরা জানতে পারছি ইচ্ছাকৃত জমি অনাবাদি রাখলে শাস্তির ব্যবস্থাও
আছে। এ পর্যবেক্ষণ আমাদের কোনো তাত্ত্বিক ধাঁধাঁয় ফেলে দেয় না। একবারে
প্রায়োগিক বাস্তবতার পরিচয় তুলে ধরে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, চীনের বিপ্লবে
কৃষকশ্রেণির ভূমিকা ছিলো অগ্রগণ্য। তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণি হিসেবে এ
বিপ্লবে অংশ নিয়েছে। জোসেফ নীডহাম তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, চীনের সভ্যতা
কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। ইউরোপের মতো নৌবাণিজ্য-সভ্যতা নয়। চীনা সমাজে বণিক
পুঁজির শক্তি ইউরোপের মতো প্রবল নয়। তাই সেখানে কৃষিজীবীর ভূমিকা প্রবল।
নীডহামের গবেষণায় চীনের সামাজিক স্তর বিন্যাস ভারতীয়দের চেয়ে যে ভিন্ন তাও
প্রকাশিত। যেমন, ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এ
চতুর্বণীয় বিভাজনের যে অনড়ত্ব আছে চীনা সমাজ তেমন নয়। সেখানে সবার ওপরে
সামন্তভূমি মালিক শ্রেণি যারা সরকারি কাজেও নিয়োজিত (ংপযড়ষধৎ-মবহঃৎু )
এরপরই কৃষক শ্রেণির অবস্থান। এরপর হস্তশিল্পীরা মোটাদাগে শ্রমজীবীরা এবং
সবার পরে বণিকশ্রেণি [ ঘোষ ( উদ্ধৃত; ২০২০ : ১৮২-৮৩)]। বোঝাই যায় সমাজে
কৃষকদের অবস্থান কতো ওপরে। কৃষকশ্রেণিকে আবার লিঙ্গভিত্তিক সমতায় নিয়ে আসা
হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলছেন, “ জমি যে ভাগ করে দেয়া হয়েছে তা পুরুষের মধ্যে
সীমাবদ্ধ নয়; স্বামী জমি যাহা পাবে স্ত্রীও সমপরিমাণ জমি পাবে এবং দুজনকে
পরিশ্রম করতে হবে। কারণ দুজনই জমির মালিক। স্বামী কাজ করবে আর স্ত্রী বসে
খাবে এ প্রথা চীনের থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমি ট্রেন থেকে পুরুষ ও মেয়েলোক
অনেককেই হালচাষ করতে দেখেছি [রহমান (২০২০ : ৯০)]।”
চীনের
পরিবর্তনশীলতা তুলে ধরতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে আসে আমাদের দেশের কথা। আমরা কেন
পারছি না। সে প্রসঙ্গ। আমাদের উদ্ধৃতি একটু দীর্ঘ হয়ে যাবে তবুও বাস্তবতা
বোঝার জন্যে সে উদ্ধৃতি অবশ্যই দেবো:
চীন দেশের অধিকাংশেরও বেশি লোক
বৌদ্ধ। তারা সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের নামের দোহাই দিয়ে নিরীহ মুসলমানদের ওপর ,
খ্রিষ্টানদের ওপর অত্যাচার করেছে। চিয়াংকোইশেক সরকার এই অত্যাচার কোনোদিন
বন্ধ করতে পারে নাই অথবা চেষ্টা করে নাই।
সরকার ইচ্ছা করলে
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা বন্ধ করতে পারে না, এ আমি বিশ্বাস করি না। আজ
হিন্দুস্তানে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু যদিও চান না কোনো সম্প্রদায়
অন্যসম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার করুক, কিন্তু তার সরকারের পক্ষে
দাঙ্গাহাঙ্গামা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, তাঁর দলবলের মধ্যে এমন লোক
আছে যারা এটাকে জিািইয়া রাখতে চায়। তাই পণ্ডিতজি শত চেষ্টা করেও দাঙ্গা
থামাতে সমর্থ হচ্ছেন না। এই একইভাবে চিয়াং কাইশেকের চীনে দাঙ্গাহাঙ্গামা
হয়ে গ্রামের পর গ্রাম ছারখার হয়ে যেত।
নয়াচীন সরকার দাঙ্গা নির্মূলে
নজন দিলেন। বিপ্লবের পর মাও সে তুং-এর নেতুত্বে চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি
ক্ষমতায় আসার পরে আজ পর্যন্ত একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা চীনে হয়
নাই। যারাই চেষ্টা করেছে, সরকার কঠোর ভাবে তাদের শায়েস্তা করে দিয়েছে।
আমাদের মুসলমান সম্প্রদায়ের ধ্যে একটা প্রবল প্রচার ও বিশ্বাস আছে যে, চীনে মুসলমানরা খুবই নর্িা
কতগুলো
বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত খুব দৃঢ় প্রত্যয়ী। যেমন এ ভ্রমণকাহিনিতে চীনের
দুর্নীতি নিধনে সাফল্যের প্রসঙ্গ এসেছে সে সঙ্গে নিজ দেশের বাস্তবতা। তিনি
বলছেন:
পূর্বে শুনতাম, দারোগা পুলিশের মতো কেউ ঘুষ খায় না। তারপর
শুনতাম কাস্টমস অফিসারদের মতো কেউ ঘুষ খায় না। আমি কয়েক বছর রাজবন্দি
হিসেবে জেল খেটেছি, তাতে দেখেছি জেলখানার মতো বৈজ্ঞানিকভাবে ঘুষ বোধ হয়
কোনো ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা নিতে জানে না । ৃ জলখানা, পুলিশ
ডিপার্টমেন্ট, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট, কাস্টম্স, কোর্ট-কাচারি,
সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, ইনকাম ট্যাক্স, কারো চেয়ে কেউ কম না, এই ধারণাই আমার
শেষ পর্যন্ত হয়েছে। (১০৪)
চিয়াং কাইশেকের আমলের পরিস্থিতি সামাল দিয়ে
কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে? বঙ্গবন্ধু বলছেন, “ নয়াচীন থেকে দুর্নীতি তুলে
দেওয়া সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে, রাষ্ট্রের কর্ণধাররা ঘুষ দুর্নীতি তুলে
দিতে বদ্ধ পরিকর। আমি নয়াচীনে একটা ঘটনা শুনেছিলাম যে, মাও সে তুংয়ের একজন
প্রধান বন্ধু এবং নয়াচীনের নেতা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলো বলে তাকে
বিচার করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো। ইচ্ছা করলে মাও সে তুং তাকে রক্ষা করতে
পারতেন। কিন্তু বিচারে যাকে ফাঁসির হুকুম দিয়েছে তাকে রক্ষা করা অন্যায়।“
(১০৪-৫) এখানে বিচারভিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি
এসেে যায়। এরপর তিনি প্রশ্নটা করছেন, ‘ দেশের রাষ্ট্রনায়করা যদি
দুর্নীতিপরায়ণ হয়, তবে আর দেশের কর্মচারী ও জনগণ দুর্নীতিপরায়ণ কেন হবে
না?” ১০৫
আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষা করবেন।
এ
গ্রন্থ আমাদের এ শিক্ষা দেয় দেশ ভ্রমণে গেলে কেবল প্রকৃতি আরদর্শনীয় স্থান
থেখে মুগ্ধ হয়ে চলে এলে সে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। একটা দেশ দেখা মানে
সে দেশের মানুষ, জনজীবন, রাজনতিক ব্যবস্থাপনা ার সংস্কৃতির নিবিড় ভাবে
দেখতে হয়। তাহলেআ ভ্রমণ সার্থক হতে পারে।
আমরা শিরোনামে বলেছি ‘বিকল্প’
বয়ানের কথা। এ ভ্রমণকাহিনি আদতে বিকল্প সব বয়ান তৈরি করে। চীনের
পরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে যেসব আদি বয়ান প্রচলিত ও ব্যাপক প্রচারিত তা খণ্ডন
করে দারুণভাবে। ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়
সুরক্ষা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ আমাদে খুব সহযোগিতা করে নতুন করে
ভাবতে। দুর্নীতি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চীনের সফলতার কথা শোনায়। মাতৃভাষায়
শিক্ষাচর্চায় চীনের জোর সমকালে সমালেঅচিত হলেও কালের পরীক্ষায় উত্তর্ণ হয়।
বঙ্গবন্ধু আমাদের জানান কীভাবে ইংরেজি মাধ্যম লঘু করে তারা ম্যান্যারিনের
একক কতৃত্ব প্রতিঠ্ঠিত করেছিলো তাদের জন্য। যার সুফল আজ উজ্জ্বল নির্দশন।
ভাষায় ক্রিয়াপদ, শব্দ আর অভিব্যক্তি প্রাশ করলে তা নিজের দেশের হয়ে উঠতে
পারে তাও এ গ্রন্থ আমাদের শেখায়। কীভাবে স্বদেশ এ আসলে বিকল্প
ভ্রমণকাহিনির অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠেছে।
J . A. Cuddon, A Dictionary of Literary Terms and Literary Theory West Sussex 2013 Willey-Blackwell
শেখ মুজিবুর রহমান আমার দেখা নয়াচীন ঢাকা বাংলা একাডেমি ২০২০
বিনয় ঘোষ বাংলার নবজাগৃতি কলিকাতা ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড চতুর্থ মু. ১৪০২