ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বাল্যবিয়ে: শুধু আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়
Published : Wednesday, 29 September, 2021 at 12:00 AM
বাল্যবিয়ে: শুধু আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়রাজীব সরকার ||
করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলেছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে ফিরেছে- এটি স্বস্তিদায়ক দৃশ্য। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বহু শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার খবর উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, এই দেড় বছরে অনেক ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, যা মহামারির চেয়ে কম বিপর্যয় নয়। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না পারলে নারীর ক্ষমতায়ন হুমকির মুখে পড়বে।
জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সদস্য দেশগুলো কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য বিশ্নেষণ করলে দেখা যাবে, একাধিক লক্ষ্যের সঙ্গে বাল্যবিয়ের প্রভাব সম্পৃক্ত। তিন, চার ও পাঁচ নম্বর লক্ষ্য যথাক্রমে সুস্বাস্থ্য, মানসম্মত শিক্ষা এবং জেন্ডার সমতা। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা অকালে অন্তঃসত্ত্বা হয়। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু এবং অপুষ্ট ও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মদানের মতো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় তারা।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে চলছে। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা অকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ে। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ নারীদের একটি বড় অংশ শিক্ষাবঞ্চিত থাকার অর্থ সামাজিক পশ্চাদপসরণ। জেন্ডার সমতা কখনোই অর্জিত হবে না, যদি নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হয়। শিক্ষার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়া তথা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নারীর ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত। এক্ষেত্রেও বাল্যবিয়ে প্রতিবন্ধক।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার সেই তুলনায় সামান্য কমেছে। বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি দূর করার জন্য সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর বাইরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং সংবাদমাধ্যমও এই ব্যাধির বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। প্রায় শতবর্ষ পুরোনো 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯' বাতিল করে সরকার যুগোপযোগী 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭' প্রণয়ন করেছে। আইনটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের তফসিলভুক্ত হওয়ায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছেন। 'প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ে বন্ধ'- প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের খবর আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই। এরপরও বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হচ্ছে না। মাঠ প্রশাসনে এক যুগের কাজের অভিজ্ঞতার সূত্রে এ প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করতে চাই।
শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে জনসাধারণের একটি বড় অংশের মধ্যে নারী সম্পর্কে মানস প্রতিবন্ধ কাজ করে। এ দেশের সিংহভাগ দম্পতি কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তানকে শ্রেয়তর মনে করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অভূতপূর্ব অগ্রগতি সত্ত্বেও অনেক অভিভাবক মেয়েকে পরিবারের বোঝা হিসেবে বিবেচনা করেন। মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিতে পারলে বোঝা হালকা হবে এবং 'দারিদ্র্য' থেকে পরিবার মুক্ত হবে- এমন অবৈজ্ঞানিক ধারণা থেকে তারা বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেখান। অথচ বাল্যবিয়ের ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পায় এমন তাত্ত্বিক বা বাস্তব উদাহরণ নেই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ধারণাও বদ্ধমূল যে, কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়া হলে যৌতুক দিতে হয় না। মেয়ের বয়স বেশি হলে যৌতুকের পরিমাণ বেড়ে যায়। কাজেই অনেকের কাছে বাল্যবিয়ে 'অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক'।
বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও শিক্ষিত মহলের জোর তৎপরতার কারণে বিয়ে নিবন্ধকরা এ বিষয়ে সচেতন হয়েছেন। আইনের ভয় এবং সচেতনতা উভয় কারণেই তারা সাধারণত কোনো বাল্যবিয়ে আয়োজনে সম্পৃক্ত হন না। এর দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। নিবন্ধন ছাড়াই স্থানীয় মসজিদের ইমাম বা মৌলভী বিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে সেই মেয়েটির জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। নিবন্ধন ছাড়া এই বিয়েকে যে কোনো সময় বরপক্ষ অস্বীকার করতে পারে এবং আজীবন দুর্ভোগের মুখে পড়তে পারে মেয়েটি। আরেকটি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, অন্য কোনো জেলায় বা দূরবর্তী কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যেন স্থানীয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নিতে পারে। শুধু আইন প্রয়োগ করে কি এই আত্মঘাতী প্রবণতা রোধ করা সম্ভব?
সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭' অনুযায়ী কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। প্রতিবছর মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্টুডেন্টস কেবিনেট গঠিত হয়। নেতৃত্বগুণ বিকাশের জন্য তৈরি এই কেবিনেটের সদস্যরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকে বাল্যবিয়েমুক্ত করার জন্য অবদান রাখতে পারে। সরকারি উদ্যোগে দেশের সব উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। এ কার্যক্রম কন্যাশিশুদের শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের জন্য সহায়ক হবে। প্রশাসন ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পাশাপাশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, এনজিও কর্মী, নারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, কাজী, ইমাম, পুরোহিত কারও অবদানই এ ক্ষেত্রে কম নয়। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামাজিক জাগরণের কোনো বিকল্প নেই।
বাল্যবিয়ে নিরোধে সরকার আন্তরিক। ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিয়ে বন্ধ করা, ২০২১ সালে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের হার এক-তৃতীয়াংশ কমানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণ নির্মূল করার লক্ষ্য রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের যে স্বপ্টম্ন আমরা দেখছি তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে বাল্যবিয়ের কারণে। এ ব্যাধি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে পারলে এসডিজি অর্জন সহজতর হবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন নারী সম্পর্কে মানস প্রতিবন্ধের বেড়াজাল থেকে আমাদের মুক্তিলাভ। নারীকে নিছক 'নারী' নয়, তাকে 'মানুষ' হিসেবে গণ্য করার মানসিকতা গঠন একান্ত অপরিহার্য।
লেখক: সচিব (উপসচিব), ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন