
অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ।।
২০২০
এর ৮ই মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। আর ২০২১ এর মার্চ
থেকে শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের
সংক্রমণের তীব্রতা ও মৃত্যুর সংখ্যা অত্যধিক। গত জুন’২১ থেকে দেশের বিভিন্ন
এলাকায় করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট (ভারত থেকে যার উৎপত্তি) ছড়াতে শুরু করলে
নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুন’২১ এর শেষের দিকে মৃত্যু বাড়তে থাকে এবং
জুলাই’২১ এসে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার ধারন করে। হাসপাতালে বেডের অভাব ও
অক্সিজেন সরবরাহে স্বল্পতা এ ভয়ংকর রূপের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন।
আগস্ট’২১ এর শুরু থেকে করোনা সংক্রমণের নি¤œমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনেক
বিশেষজ্ঞরাই বলেছেন শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের নি¤েœ নেমেছে।
এটাকে ৫
শতাংশের নি¤েœ নামিয়ে আনতে হবে। আর যদি এ হার ক্রমান্বয়ে কমপক্ষে ১০ দিন
বজায় রাখা যায় তবে বলা যাবে করোনা নিয়ন্ত্রণের দিকে আসছে। দেশে করোনা
সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই নারীদের মৃত্যুহার কম ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ আসার
সঙ্গে সঙ্গেই এ হার বেড়ে গেছে। বর্তমানে নারীদের মৃত্যুহার প্রায় ৩৫
শতাংশ। গত মার্চ’২১ পর্যন্ত এ মৃত্যুহার ছিল ২৫ শতাংশের কম। গত ২৭
আগস্ট’২১, ২৪ ঘন্টায় ২৭ হাজার ৫৭৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার
বিপরীতে শনাক্তের হার ১২.৭৮ শতাংশ। গত দুই মাসের মধ্যে এটাই ছিল শনাক্তের
সর্বনি¤œ হার। এখন শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের নীচেই এবং নতুন রোগীর সংখ্যাও
কমেছে। মৃত্যু হারও অনেক কমেছে যেমন গত ২৮ আগস্ট’২১ মৃত্যু সংখ্যা ছিল ৮৯
জন যা তার পূর্বে ২০০ এর নীচে দেখা যায় নাই।
গত ২০০০ সনের ডিসেম্বর
মাসে চূড়ান্ত করা জাতীয় করোনা টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনায় জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে
নিশ্চিত করার কথা ঠিক করা আছে। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লক্ষ ১০
হাজার। এ হিসেব অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৩ কোটি ৫১ লাখের বেশী মানুষকে
টিকা দিতে চাচ্ছে। পূর্ণ দুই ডোজ টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান
অত্যন্ত নাজুক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী ২৭ আগস্ট’২১
পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু মিয়ানমারের
চেয়ে বেশি। এরই মধ্যে গত ২৩ আগস্ট ’২১ মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৮ কোটি
মানুষকে টিকা দেয়া হবে। বাকী সাড়ে ৫ কোটি মানুষ কবে টিকা পাবেন মন্ত্রীর
বক্তব্যে তার কোন উল্লেখ ছিল না। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ৮ কোটি মানুষকে
টিকা দিতে হলে টিকা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা কোত্থেকে হবে সেটা ভাববার বিষয়। ৮
কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার বিষয়টি অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। তবে টিকা
প্রয়োগ কমিটির প্রধান অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘নিয়মিত করোনা টিকা
দান কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রগুলোতে বুথের
সংখ্যা বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে দৈনিক
প্রায় পাঁচ লাখের মত টিকা দেয়া হচ্ছে। এ সংখ্যা আরো বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।’
৭
ফেব্রুয়ারি ’২১ দেশে করোনার টিকা দান শুরু হয়। ঐদিন ৩০ হাজার মানুষকে
টিকাদান করা হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট ’২১ প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে টিকা দেয়া
হয়েছে ৫ লক্ষ ১৪ হাজারের মত। ফেব্রুয়ারি’২১ থেকে মোট ১৬১ দিন টিকা দেয়া
হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। আগস্ট ’২১ এ
সম্প্রসারিত আকারে টিকা দেয়া শুরু হয়েছিল এবং এ আকারে ৬ দিন টিকা দেয়া
হয়েছে। ঐ ৬ দিনে ৫৩ লক্ষ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেয়া
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি’২২ এর মধ্যে ১৬ কোটি ডোজ টিকা দিতে হবে।
ইতিমধ্যে দেয়া হয়েছে ২ কোটি ৫৩ লক্ষ ডোজ। আরও ১৩ কোটি ৪৭ লক্ষের মত টিকা
মানুষকে দিতে হবে। এর মধ্যে যে কর্মদিবস আছে তা হিসেবে দৈনিক সাড়ে ৮ লাখের
মত টিকা দেয়া সম্ভব হবে। বিগত ৭ মাসে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪.৩ শতাংশ
মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ হারে টিকা দিলে বাকী ৭৬ শতাংশ
টিকা দিতে প্রায় ১৩৩ মাস বা ১১ বছর সময় লেগে যাবে।
স্বাস্থ্য বিভাগ
৭ আগস্ট ’২১ থেকে ৬ দিন গোটা দেশে সম্প্রসারিত আকারে যে টিকা দিয়েছিল তাকে
গণটিকাদান বলেছিল। নিয়মিত টিকা দানের সঙ্গে ৪,৬০০ ইউনিয়ন, ১,০৫৪টি পৌরসভা ও
১২টি সিটি কর্পোরেশেনের ৪৩৩ টি ওয়ার্ডে টিকা দেয়া হচ্ছিল। তবে গণটিকা
দানের ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানাবিধ সমালোচনাও হয়েছিল। কিছু কিছু কেন্দ্রে
নিজেদের পছন্দের মানুষকে টিকা দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল। নিবন্ধন করা মানুষ
অনেকদিন অপেক্ষায় থাকলেও কেন্দ্রে নিবন্ধন করেই অনেকে চটজলদি টিকা পেয়ে
যান। এ নিয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও আলোচনা হয়। এসকল কারণে
গণটিকাদান কর্মসূচি আর চলবে না।
দেশে এ পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে
টিকা এসেছে ৩ কোটি ১৭ লক্ষ ২৫ হাজার ডোজ। ইতিমধ্যে দেয়া হয়েছে ২ কোটি ৫৩
লাখের মত। দেশে বর্তমানে এস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, সিনোফার্ম ও মডার্নার টিকা
দেয়া হচ্ছে। ভারত থেকে উপহার ও কেনা টিকা দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল
ফেব্রুয়ারি’২১ এ। কিন্তু মার্চ ’২১ এর পর ভারত রপ্তানি স্থগিত করায় দেশে
টিকা কর্মসূচি গতি হারায়। এরপর সরকার চীনের সিনোফার্মা থেকে টিকা কিনছে।
এছাড়া কোভেক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান বাংলাদেশকে টিকা দিয়েছে। সরকার
সিনোফার্মার সাথে টিকা বোতলজাত করণের চুক্তিও সম্পাদন করেছে।
জনস্বাস্থ্যবিদদের প্রস্তাবনা হচ্ছে সংক্ষিপ্ত সময়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে
টিকা দেয়া। সম্ভব্য সব ধরনের উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ বজায় রাখতে হবে। শুরুর
দিকে ভারত নির্ভরতা ও বর্তমানে চীনের উপর বেশি নির্ভরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সরকাররের উচিত হবে টিকার আরও উৎস খোজা অথবা টিকা উৎপন্নের ব্যবস্থা করা।
দেশীয় কোম্পানি ওহপবঢ়ঃধ টিকা প্রস্তুত সক্ষম বলে দাবি করেছে। সিনোফার্মার
পাশাপাশি ওহপবঢ়ঃধকেও টিকা উৎপন্নের অনুমোদন দিলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮০
ভাগকে টিকা দান সার্বিকভাবে সম্ভব হবে বলে অনেক জনস্বাস্থ্যবিদ মনে করেন।
শতকরা ৮০-৯০ ভাগ জনগোষ্ঠী ফেব্রুয়ারি’২২ এর মধ্যে ২ ডোজ টিকা সম্পন্ন করতে
পারলে করোনা ভাইরাসের চেইন নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমাদের অভিষ্ঠ লক্ষ্য
হার্ডইমিউনিটিকে অর্জন করতে আমরা সক্ষম হব।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল