ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
একটি ভ্রমণের সাতকাহন
Published : Tuesday, 12 October, 2021 at 12:00 AM
একটি ভ্রমণের সাতকাহনশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ।।

দ্বিতীয় অধ্যায়
এখন আমি গয়াধামের কথা লিখব।
পুণ্যধাম গয়াব কথা বলতে গেলে প্রথমই উল্লেখ করতে হয় শুষ্ক স্রোতহীনা ফল্গুনদীর কথা। কথিত আছে- জনকনন্দিনী সীতার অভিশাপে অন্ত:সলিলা এই নদী যুগ-যুগান্ত ধরে এরকমই রুক্ষ, বালুকাময়। তবে বর্ষাকালে ভারী বর্ষণের পর ফল্গু সাধারণ নিয়মেই এক স্বাভাবিক নদীর চেহারা নিলেও, দু-তিন মাস কাটতে না কাটতেই পুনরায় এক চিলতে মরুভূমি।
শাপগ্রস্ত হলেও মোক্ষদায়িণী ফল্গু এক পবিত্র নদীরূপে স্বীকৃত। ভারতবর্ষের প্রাচীন শহরগুলোর অন্যতম পিণ্ডক্ষেত্র, পুণ্যতীর্থ গয়া ফল্গু নদীর পশ্চিম পাড়ে। মুক্তিধাম গয়া শ্রাদ্ধ, তর্পণ ও পিণ্ডদানের জন্য প্রাচীনকাল থেকে প্রসিদ্ধ। ফল্গুর পশ্চিম পাড়ে শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম মন্দির। পূর্ব পাড়ে সীতাকুণ্ড।
কিংবদন্তি, এখানেই অযোধ্যার রাজা স্বর্গীয় দশরথের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করেছিলেন পুত্রবধূ সীতা। ত্রেতাযুগের এক মনোমুগ্ধকর কাহিনি। তারপরই ‘সীতাকুণ্ড’ তীর্থের সৃষ্টি।
ফল্গুর তীর ছুঁয়ে নানা দেবদেবীর ছোট-বড় মন্দিরের পাশাপাশি শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম মন্দির এবং সীতাকুণ্ডের অবস্থান এই নদীকে আরও মহিমান্বিতা করেছে। বায়ুপুরাণে ফল্গুকে তীর্থরূপে বর্ণনা করা হয়েছে-ফল্গুতীর্থ। এমনকী এই ফল্গুতীর্থ হলো- ‘সর্বতীর্থোত্তম’।
মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নয়। গয়ায় যে ৪৫টি তীর্থে শ্রাদ্ধ ও পিণ্ডদানের শাস্ত্রীয় বিধান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই ফল্গু তীর্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমানে সময়াভাবে ৪৫টি তীর্থ বেদিতে পিণ্ডদান করা সম্ভব হয় না বলে স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে প্রধানত তিন জায়গায় পিণ্ডদানের কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে। প্রথমেই ফল্গুতীর্থ, তারপর শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম মন্দির, সবশেষে অক্ষয় বট। তবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে অর্থাৎ অপঘাতে মৃত্যু কিংবা আত্মহত্যা, মৃত ব্যক্তির আত্মার সদ্গতির জন্য এই তিনটি জায়গার সঙ্গে সঙ্গে প্রেতশিলায় গিয়েও পিণ্ডদান করতে হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, গয়ায় নিয়মনিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পিণ্ডদানের কাজ সু-সম্পন্ন করতে পারলে সমস্ত জাগতিক মায়া-বন্ধন থেকে অতৃপ্ত আত্মার চিরতরে মুক্তিলাভ ঘটে।
যুগ যুগ ধরে ঋষি-মুনিদের আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড যা ভারতবর্ষের পুণ্যভূমিতে এক শাশ্বত ধর্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, তার সর্বোপরি কথাই হলো শ্রদ্ধা ও ভক্তি। এই ভক্তিমার্গের পথ ধরেই যে করুণাময় ঈশ্বরকে আপন অন্তরে আপনার করে পাওয়া যায়। সন্তানের কাছে পিতা-মাতা হলেন ঈশ্বরেরই যেন জীবন্ত রূপ। (আজকাল এই ধারণা অনেকাংশে বদলে গিয়েছে।) উপনিষদের ‘পিতৃদেবো ভব, মাতৃদেবো ভব’ কথাটি তাই আজকাল মাঝে মাঝে আমার অর্থহীন মনে হয়। আবার কষ্টও হয়, যখন বৃদ্ধ বাবা-মাকে অবহেলা করা হয়, কষ্ট দেয়া হয়। এমনকি পরিত্যাগ করা হয়।
যে কথা বলছিলাম শ্রদ্ধা-ভক্তির মধ্য দিয়ে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজা আধ্যাত্মিক বিধিবিধানের অনিবার্য অঙ্গ। এই পূজায় পূর্বপুরুষদের প্রতি আমরা যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করি। এই ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে পর্যাপ্ত সুখ ও আনন্দ অনুভব করা যায়। আর এটাই হলো ভারতীয় সংস্কৃতির বিশেষত্ব। শ্রাদ্ধ অর্থাৎ পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের যতরকম বিধান রয়েছে তার প্রধান কথাই হলো শ্রদ্ধা। শাস্ত্রে এই শ্রাদ্ধকেই সবথেকে কল্যাণকারী কর্ম বলা হয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাস হলো- গয়াক্ষেত্রে পিতৃকুল ও মাতৃকুলের শ্রাদ্ধ করলে সেইসব আত্মার স্থান হয় ব্রহ্মলোকে। বিদেহী আত্মা সমস্ত পাপমুক্ত হয়ে পুনরাগমন থেকে নিষ্কৃতি পায়। এই অটুট বিশ্বাসকে সম্বল করেই সারা বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের অগুনতি নারী-পুরুষ গয়ায় এসে পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তিকামনায় তর্পণ, পিণ্ডদান, পিতৃপূজা, মাতৃপূজা প্রভৃতি শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
পুণ্যক্ষেত্র গয়াধাম সম্পর্কে একটি পৌরাণিক গল্প আছে। গয়াধামের সৃষ্টি যার নাম থেকে সেই গয়াসুরকে নিয়েই কাহিনি।
দেবতাদের কাছে গয়াসুর এই বর প্রার্থনা করেছিল- ‘যে পর্যন্ত পৃথিবী, পর্বত, চন্দ্র, সূর্য, তারা থাকবে ততদিন পর্যন্ত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং অন্য দেবতাগণ এই শিলায় (আমার অর্থাৎ গয়াসুরের দেহের উপর স্থাপিত শিলায়) অবস্থান করুন। আর আমার নামে এই ক্ষেত্র প্রসিদ্ধ হোক। পঞ্চক্রোশ গয়াক্ষেত্র ও ক্রোশমাত্র গয়াশির-এর মধ্যে সমস্ত তীর্থ বিদ্যমান থাকুক যাতে মানবজাতির প্রকৃত কল্যাণ হয়। অগণিত মানুষ আমার দেহে প্রতিষ্ঠিত এই সকল তীর্থে স্নান, তর্পণ ও পিণ্ডদান করে শত-সহস্রকুল উদ্ধার করুক। হে দেবগণ, আপনারা ব্যক্ত ও অব্যক্তরূপে সর্বদা এই ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত হোন। গদাধর স্বয়ং নিখিল বিশ্বের পাপ নাশ করুন আর এখানে যে সকল সপিণ্ডগণের শ্রাদ্ধ করা হবে, তাঁরা যেন অচিরেই ব্রহ্মলোকে গমন করেন। এই তীর্থসেবীগণের ব্রহ্মহত্যাদি পাপ বিনষ্ট হোক।’
এরপর নারায়ণসহ দেবতারা প্রসন্ন মনে ‘তথাস্তু’ বলে গয়াসুরকে আশীর্বাদ করেন। তখন থেকে ‘সে যে প্রার্থনা করেছে সবই একে একে পূরণ হবে। অতএব, গয়া এমনই এক তীর্থ যেখানে পিণ্ডদানকারী অচিরেই পিতা-মাতা এবং পূর্বপুরুষদের ঋণভার থেকে মুক্ত হয়।’
    গয়াধামে শ্রাদ্ধ ও পিণ্ডদান সম্বন্ধে কিছু জরুরি তথ্য-
১.    মৃতের বার্ষিক সপিণ্ডকরণের আগে গয়ায় পিণ্ডদানের কাজ হয় না।
২.    সাধারণ নিয়মে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধক্রিয়ার এক বছর পরে মাসিক শ্রাদ্ধ ও সপিণ্ডকরণ করে গয়ায় পিণ্ডদানের কাজ করা যায়। বাৎসরিক না হওয়া পর্যন্ত অশৌচ থাকে। তাই পিণ্ডদান নিষিদ্ধ।
(এজন্যই মৃত ব্যক্তির পরিবারে একবছর কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা হয় না।)
৩.    মৃতের একমাত্র পুত্র থাকলে শ্রাদ্ধের পরই বাড়িতে সপিণ্ডকরণ করা যায়। এগারো দিনে আদ্যশ্রাদ্ধ। বারো দিনে নিয়মভঙ্গ। তেরো দিনে বাৎসরিক। কিন্তু মৃতের একাধিক পুত্র থাকলে শ্রাদ্ধের পরপরই বাৎসরিক সম্ভব নয়।
৪.    পতি-পুত্রবতী নারী কারও পিণ্ডদানের অধিকারিণী নন।
৫.    পিতা জীবিত থাকলে পুত্রের গয়াতে পিণ্ডদান নিষিদ্ধ। এমনকী মৃত মায়ের পিণ্ডদানও পুত্র করতে পারবেনা।
৬.    সপিণ্ডকরণ পতিত হলে অর্থাৎ মৃত্যুর পর বৎসরান্তে সেই নির্দিষ্ট তিথিতে করা না হলে, যে কোনও অমাবস্যা বা কৃষ্ণা একাদশীতে সপিণ্ডকরণ করে গয়ায় পিণ্ড দেওয়া হয়।
৭.    মৃত ব্যক্তি যে কোনও গোত্রের বা শ্রেণির হোন না কেন, যে কেউ তাঁর নামে গয়ায় পিণ্ড দিতে পারে। ব্রাহ্মণ তাঁর প্রতিনিধি হয়ে গয়ায় পিণ্ডদান করতে পারেন।
৮.    শ্বশুরমশাই জীবিত থাকলেও মৃত স্বামীর পিণ্ডদান স্ত্রী করতে পারেন। পিতাও ইচ্ছে করলে পুত্রের পিণ্ডদান করতে পারেন।
৯.    যিনি মারা গিয়েছেন তাঁর পুত্র বা কন্যাসন্তান থাকলে, তাঁরা যদি সাবালক বা সাবালিকা হন, পিতার পিণ্ডদানের প্রথম অধিকার তাঁদের। তবে সেক্ষেত্রে কন্যাসন্তানকে অবিবাহিত হতে হবে।

প্রত্যেক মানুষের শরীর ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পঞ্চ ভৌতিক দ্বারা গঠিত। মৃত্যুর পর এই পাঁচটি অংশ পাঁচটির সঙ্গে মিশে যায়। তারপর প্রত্যেক দিন পূরক পিণ্ডের দ্বারা একটি সূক্ষ্ম শরীর গঠিত হয়। পরে ওই সূক্ষ্ম শরীরকে শ্রাদ্ধাদির দ্বারা তার পুষ্টিসাধন করতে হয়। আমাদের যেটা এক মাস প্রেতলোকের সেটা একদিন। অতএব প্রত্যেক মাসে এক একটি মাসিক শ্রাদ্ধ করলে প্রেতলোকে প্রেতাত্মা প্রত্যেক দিন কিছু খেতে পায়। বারো মাসে বারোটি ও প্রথম ষান্মাসিক, দ্বিতীয় ষান্মাসিক মোট ১৪টি মাসিক করার পর সপিণ্ডকরণের দ্বারা প্রেতাত্মা পিতৃলোকে গমন করে।
শাস্ত্রের কথা হলো- বৎসরান্তে মৃত্যুর তিথিতে মৃতব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ বা কিছু ভোজ্য বস্তু দান করলে, তিনি যে যোনিতে থাকুন না কেন সেই যোনির আহার্যরূপে তাঁর নিকট উপস্থিত হয়। যেহেতু মৃত ব্যক্তি সঙ্গে কিছু নিয়ে যাননি সেজন্য তাঁর ব্যবহারের জন্য যা যা জিনিস নিত্য প্রয়োজন সেই সকল জিনিস মৃতের ওয়ারিশগণ দান করবেন। দান না করলে মৃত ব্যক্তি কোথাও কিছু পাবেন না।
অন্য মতবাদ হলো- মৃত্যুর পর মানবাত্মা এক বছর প্রেত হিসেবে প্রেতলোকে তথা প্রেতযোনিতে থাকে। এই সময় আত্মার খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনও থাকে। একবছর পর প্রেতযোনি থেকে প্রেতাত্মা মুক্তি পায় ও পুনর্জন্ম লাভ করে। মতান্তরে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হয় বা দেবলোকে গমন করে। তখন আর কোনও পার্থিব প্রয়োজন তার থাকে না। তাই মৃত্যুর পর এক বছর পর্যন্ত প্রেতপূজার প্রচলন হলো, যার নাম শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।
(ক্রমশঃ)
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
 মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫