মোস্তফা কামাল ||
বহুদিন পর একটি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ। নানা কানাঘুষা-আলোচনা মাড়িয়ে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ঘোষণা হয়েছে নতুন দল গণঅধিকার পরিষদ। ঘোষিত দলটির প্রধান ড. রেজা কিবরিয়া। তিনি আহ্বায়ক। আর সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর সদস্য সচিব। আহ্বায়ককে রেখে এরই মধ্যে দলটির নাম প্রচার হচ্ছে সদস্য সচিবের নামে। প্রচারের সাথে অধিকার-দাপট দৃষ্টেই এমন আওয়াজ। দলটির স্লোগান- ‘জনতার অধিকার, আমাদের অঙ্গীকার’। মূল নীতি চারটি-গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ। রেজা কিবরিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে।
১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে ছাত্র, যুব, শ্রমিক অধিকার পরিষদের বর্তমান-সাবেক নেতাদের রাখা হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের জুনে নুর তরুণদের নেতৃত্বে একটা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার ব্যাপারে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। ঘোষণা ঘোষণাই থেকে যায়। সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর দল ঘোষণার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় তা হয়নি। পরিবর্তিত তারিখ ছিল ২০ অক্টোবর। প্রশাসনের অনুমতি মেলেনি। এরপর সেটিও পরিবর্তন করে ২৬ অক্টোবর প্রোগ্রাম করতে প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়। সেই মোতাবেক ২৬ অক্টোবর প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে রাজধানীর পল্টনের প্রিতম জামান টাওয়ারে দলটির কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের নাম ঘোষণা করেন নুরুল হক নুর। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে।
নুরুল হক নুরের রাজনৈতিক জন্ম ছাত্রলীগে। বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্যতম যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। এর আগে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মুহসীন হলের উপ-মানব উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক। স্কুল জীবনে ছিলেন ছাত্রলীগের স্কুল কমিটির দপ্তর সম্পাদক। বিতর্ক, অভিনয়সহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত ছিলেন।
ভিত্তিটা ছাত্রলীগে হলেও এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে বেদম মার খেতে খেতেই তার উতরে ওঠা। ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশের কর্মসূচি দেন নুর। ওই সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে দু’পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে ডাকসু ভবনে নুর ও তার সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সদস্যদের ভীষণ মার দেয় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কর্মীরা। নেপথ্যে থাকে ছাত্রলীগ।
ওই মারে তার প্রতি মানুষের একটি সাধারণ সিম্প্যাথি তৈরি হয়। মারের পর দেয়া হয় মামলাও। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নুরু বিভিন্ন আন্দোলনে অন্তত সাতবার হামলার শিকার হন। এছাড়া একই সালে ডাকসু নির্বাচন চলাকালীন রোকেয়া হলের প্রভোস্টকে লাঞ্ছিত ও ভাঙচুরের অভিযোগে নুরুল হকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নুরসহ সাতজনকে আটক করার কয়েক ঘণ্টা পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
নুরসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের মামলা করা হয়েছিল। সেই মামলার বিরুদ্ধে শাহবাগে বিক্ষোভ করছিলেন নুরুল হক নুর ও সাধারণ ছাত্র পরিষদ নামে তার সংগঠনের সদস্যরা। সেই বিক্ষোভ চলাকালীন তাদের আটক করা হয় এবং কিছুক্ষণ পর মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতো মারের পরও নুর মাঠ ছাড়েননি- এটি তার অন্যতম গুণ বা অর্জন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে তিনি মায়ের ছায়া দেখেন মন্তব্য করেও আলোচিত। সবমিলিয়ে নুরের উত্থান অনেকটা দয়ামায়ার জের। ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের মতো ব্যক্তিদের স্নেহভাজন। তাদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগও তার। ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের ‘গণ’ এবং ড. কামালের দলের নেতা রেজা কিবরিয়াকে নিয়েই এখন করলেন দল।
সীমিত এই অতীত নিয়ে নুর কোন অসীম ভবিষ্যতে এগোচ্ছেন সেটা সময়ের অপেক্ষা। তিনি ডাকসুর ভিপি ছিলেন, ছাত্রলীগের বড় নেতা ছিলেন না। সেই মানদণ্ডে তার চেয়ে বড় বড় অনেক তারকা নেতা হারিয়ে গেছেন। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের পুনঃজন্মকালে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। বিগ শট নেতা ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমানও।
মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রউফও কম ছিলেন না। ফেরদৌস আহম্মেদ কোরেশী তো ছিলেন কিংবদন্তি। খালেদ মোহাম্মদ আলী, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শেখ শহিদুল ইসলাম, এম এ রশিদ, মনিরুল হক চৌধুরী, শফিউল আলম প্রধান, ফজলুর রহমান,সুলতান মোহাম্মদ মনসুরদের নামের পাশে নাম বসানোর মতো তারকা নন নুর। এরপরও ঘটনা ও পরিস্থিতির আবশ্যকতায় হাল তারকা তিনি। তবে গন্তব্য অনিশ্চিত। কাকে নিয়ে, কাকে দিয়ে, কার মাধ্যমে, কার আশীর্বাদে এগোচ্ছেন তিনি-তাও প্রশ্নযুক্ত।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন